মা-বাবার স্নেহের ছায়ায় সন্তান বেড়ে উঠে। সময়ের সাথে সাথে ছোট্ট বাবুটাও বড় হওয়ার পথে হাঁটে। তো এই বড় হওয়ার পথে কখনো আপনার সন্তানের আচরণের মাঝে কি কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছেন? কিংবা ও হয়তো আট-দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো আচরণ করছে না! আর তাই তো ডাক্তারের কাছে গিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে শুনলেন, যে আপনার বাচ্চা অটিজমে (Autism) আক্রান্ত! একথা শুনে চিন্তায় আপনার ঘুম হারাম, ভাবছেন কি করবেন এখন? আসলে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই, একটু ধৈর্য ধরুন। আপনার সচেতনতা আর চিকিৎসকের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আপনার সন্তান স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ষোল সতের হাজারেরও বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশু আছে এবং দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। আমরা অনেকেই যথাযথ তথ্যের অভাবে এ সমস্যা সম্পর্কে ততটা সচেতন নই। অটিজম (Autism) একটি নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়বিক সমস্যা যার ফলে শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এই সমস্যায় আক্রান্তরা কথা বলতে বা কিছু বুঝতে, নতুন জিনিস শিখতে এবং সমাজে চলতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। অটিজমের চিকিৎসা পদ্ধতি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, তবে এটা প্রতিরোধযোগ্য।
আসুন অটিজম কী, কেন হয়, এ সমস্যার লক্ষণ, প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বিভিন্ন থেরাপি সম্পর্কে জেনে নিন:
অটিজম (Autism) কী
অটিজম বা অটিস্টিক একটি মনোবিকাশগত সমস্যা। অটিজম (Autism) কোন বংশগত রোগ নয় বরং এটি একটি স্নায়ুবিক বা মানসিক সমস্যা। এই সমস্যাকে ইংরেজিতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলে। অটিজমের বাংলা অর্থ হল আত্মমগ্ন থাকা, অর্থাৎ যে সারাক্ষণ নিজের জগতে আত্মমগ্ন থাকে। এই সমস্যায় আক্রান্তদের মাঝে ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, অন্ধত্ব, বধিরতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে।
অটিজম (Autism) কেন হয়
অটিজম (Autism) কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন জিনগত এবং পরিবেশগত কারণে এই সমস্যা হয়। “Mayo Clinic” একটি প্রতিবেদনে কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে যা অটিজমের জন্য দায়ী। যেমনঃ
১। Your Child’s Sex: মেয়েদের থেকে ছেলেদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার হার চার গুণ বেশী।
২। Family History: পরিবারের কোন সদস্যের অটিজম থাকলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
৩। Extremely Preterm Babies: কোন বাচ্চা যদি গর্ভধারণের ছাব্বিশ সপ্তাহ আগে জন্মগ্রহণ করে, তবে তার অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৪। Parents’ Ages: অনেক বেশী বয়সে বাচ্চা হলে, তার অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
৫। Other Disorder: বিভিন্ন রোগের কারণেও অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। যেমন: Fragile X Syndrome, বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, যক্ষা এবং আরও কিছু সমস্যা যার জন্য হাতের, মাথার এবং চোখের গঠন সুগঠিত হয় না।
অটিজমের (Autism) লক্ষণগুলো
শৈশব থেকেই এই সমস্যার সূত্রপাত হয় এবং তা জীবনব্যাপী চলতে থাকে। মূলত ১৮ মাস থেকে ৩ বছরের মাঝেই এই সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। এই সমস্যায় আক্রান্তদের যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
১। কথাবার্তা বলতে সমস্যা
ঠিকমত কথা বলতে না পারা, একই শব্দ বারবার বলা, কথার মানে বুঝতে না পারা, ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে কথা বোঝানোর চেষ্টা করা ইত্যাদি।
২। স্বাভাবিক ভাবে চলতে না পারা
অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে চায় না, একা খেলাধুলা করে, কেও কোলে নিতে গেলে বিরক্তি প্রকাশ করে, সামাজিক রীতি-নীতি বুঝতে পারেনা ইত্যাদি।
৩। কিছু শারীরিক সমস্যা
কানে শুনতে সমস্যা হয়, মানুষের স্পর্শে অস্বস্তি-বোধ করে, শব্দ, আলো এবং গন্ধে বিভিন্ন সমস্যা হয় ইত্যাদি।
৪। কিছু আচরণগত সমস্যা
অতিরিক্ত রাগ বা জেদ করা, অনেক-বেশী কান্না বা হাসি, রুটিন পরিবর্তনে ক্ষিপ্ত হওয়া, কারও চোখের দিকে কম তাকায় বা তাকায় না, কাউকে কিছু অনুরোধ করে না এবং সাহায্য চায় না ইত্যাদি।
তবে শিশু অটিজমে (Autism) আক্রান্ত কিনা তা ভালভাবে বুঝতে নিউরোলজিস্ট, ফিজিক্যাল থেরাপিস্টের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বিভিন্ন থেরাপি
অটিজম (Autism) একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা এবং তা কখনো সারে না। তবে বিশেষ কিছু থেরাপির মাধ্যমে শিশু স্বাভাবিক জীবন কাটাতে সক্ষম হয়ে উঠে। বাচ্চার আচরণগত সমস্যা দেখা দিলেই তাকে নিউরোলজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
অ্যাপ্লায়েড বিহেভিওর অ্যানালিসিস (ABA)
অ্যাপ্লায়েড বিহেভিওর অ্যানালিসিস বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন:
১। ডিসক্রিট ট্রায়াল ট্রেনিং (DTT)
অটিজম আক্রান্ত শিশুকে একটি বড় কাজকে ভেঙ্গে ছোট ছোট ভাবে করতে উৎসাহী করা হয়। এবং ঠিকভাবে কাজটি করতে পারলে তাকে পুরস্কার দেয়া হয়।
২। পিভোটাল রেসপন্স ট্রেনিং (PRT)
বাচ্চাকে বিভিন্ন নতুন জিনিস শিখতে উৎসাহ দেয়া হয়। এবং এক্ষেত্রে সাফল্য তখনই আসবে যখন বাচ্চাটা তার চাল-চলন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে।
৩। আর্লি ইন্টেনসিভ বিহেভিওরাল ইন্টারভেনশন (EIBI)
এই পদ্ধতিটি পাঁচ বছরের চেয়েও কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রযোজ্য।
৪। ভার্বাল বিহেভিওর ইন্টারভেনশন (VBI)
এই পদ্ধতিটি বাচ্চাদের ভাষা শেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
৫। ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন অফ অটিস্টিক অ্যান্ড রিলেটেড কমিউনিকেশন হ্যান্ডিক্যাপড চিলড্রেন মেথড (TEACCH)
শিশুদের বিভিন্ন গুণাবলী ও প্রতিভা নিয়ে উৎসাহ দেয়া এবং স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা। এছাড়াও এই পদ্ধতিতে শিশুকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় চলতে শেখানো হয়।
বিভিন্ন থেরাপি
থেরাপি পদ্ধতিগুলো মূলত শিশুদের উপসর্গের ভিন্নতা অনুযায়ী হয়ে থাকে। আর সেক্ষেত্রে অভিভাবক ও চিকিৎসক মিলে সিদ্ধান্ত নিন, যে কোন থেরাপিটি আপনার বাচ্চার জন্য উপকারী। যেমনঃ
১। ডেভেলপমেন্টাল, ইন্ডিভিজুয়াল ডিফেরেন্সেস, রিলেশনশিপ-বেস্ট অ্যাপ্রোচ (DIR বা ফ্লোর-টাইম)
আবেগ ও যুক্তির উন্নতি ঘটানো, শ্রবণ ক্ষমতা, দৃষ্টিশক্তি এবং গন্ধ বোঝার ক্ষমতার উন্নতি সাধন করতে এই থেরাপি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
২। অকুপেশনাল থেরাপি
এই থেরাপিতে বাচ্চাকে খাবার খাওয়া, গোসল করা এবং পোশাক পরা ইত্যাদি শেখানো হয়।
৩। স্পিচ থেরাপি
এই থেরাপির মাধ্যমে শিশুকে কথা বলা শিখতে সাহায্য করা হয়।
৪। পিকচার একচেঞ্জ কমিউনিকেশন সিস্টেম
এক্ষেত্রে শিশুকে ছবি দেখিয়ে কথা বলা শেখানো হয়।
সন্তান যে রকমই হোক না কেন, মা-বাবার কাছে তার মূল্য অনেক অনেক বেশী। আর তাইতো সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সময় থাকতে সচেতন হোন।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
তথ্যসূত্র:
১। https://www.mayoclinic.org/search/search-results?q=autism
905 total views, 1 views today