চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র ও সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম প্রাকৃতিক উপগ্রহ। চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। চাঁদ সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব ৩,৮৪,৩৯৯ কিলোমিটার বা, ২,৩৮,৮৫৫ মাইল। চাঁদ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় আছে। চাঁদ’কে ইংরেজিতে Moon বললেও বাংলায় চাঁদের বেশ কিছু সমার্থক শব্দ আছে। যেমন- শশধর, শশী, শশাঙ্ক সোম, বিধু, নিশাকর, সুধাংশু, ইন্দু, রজনীকান্ত ইত্যাদি।

                      “আয় আয় চাঁদ মামা
                               টিপ দিয়ে যা
                     চাঁদের কপালে চাঁদ
                              টিপ দিয়ে যা”

ছোট বেলায় এমন ছড়ার সুরে সুরে চাঁদ দেখিয়ে কত মা তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়েছে তার ইয়াত্তা নাই। চাঁদের গায়ে ছায়া সদৃশ যে কালো অংশ দেখা যায়, তাকে বলা হত ওখানে চাঁদের বুড়ি বসে বসে চর্কা কাটছে। আবার অনেকেই বলে ওটা চাঁদের কলঙ্কের দাগ। কিন্তু আসলেই কি ওখানে চাঁদের বুড়ি বসে আছে? চাঁদের কি কলঙ্ক আছে?

নক্ষত্রের মত চাঁদের কোন নিজস্ব আলো নাই। চন্দ্র পৃষ্ঠে সূর্যের আলো পড়লে তা থেকে আপতিত আলোর কিছু অংশ প্রতিফলিত করে, এই প্রতিফলিত আলোকেই আমরা চাঁদ হিসাবে বিভিন্ন আকারে দেখি। পদার্থবিদ্যার সূত্রানুসারে এই প্রতিফলিত আলোর পরিমান নির্ভর করে পৃষ্ঠের মসৃনতার উপর। কিন্তু চন্দ্রপৃষ্ঠ বেশ এবড়ো থেবড়ো। প্রাচীন ব্যাসল্ট দিয়ে গঠিত অনেকগুলো কঠিন লাভার আববাহিকা রয়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠে। এগুলোকে একত্রে Maria ( একবচনে Mare) বলে। ধারণা করা হয় এই অববাহিকা গুলো একসময় উল্কা ও ধূমকেতুর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব স্থান চাঁদের সমতল স্থান থেকে বেশ নিচু ও এবড়ো থেবড়ো হওয়ায় এখান থেকে আলো ভালভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না। তাইতো চাঁদের মধ্যে অবস্থিত এসব স্থানকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখায়। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলকেই আমরা চাঁদের কলঙ্ক বলি।

চাঁদের আহ্নিক গতি না থাকায় আমরা সবসময় চাঁদের একটা দিক (পার্শ্ব) দেখতে পাই। চাঁদের অর্ধাংশ সূর্যের আলোতে সব সময় আলকিত থাকে। কিন্তু পৃথিবীকে আর্বতনের সময় পৃথিবীর দিকে মুখ করা চাঁদের আলোকিত অংশের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। চাঁদ কোন কক্ষপথে আছে তার উপর নির্ভর করে চাঁদ আমাদের কাছে বিভিন্ন আকারে দেখায়। তাইতো চাঁদকে আমরা কখনো কাচির মত বাঁকা, কখনো অর্ধবৃত্তাকার, কখনো পূর্ণ দেখি। এগুলোকে চাঁদের দশা বলে। প্রতি ২৯.৫ দিনে চাঁদ তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। চাঁদের ৮টি দশা বা, পর্যায় রয়েছে। লুনার ক্যালেণ্ডার বা চন্দ্রমাসিক দিনপঞ্জি অনুযায়ী চাঁদের ৮টি দশা হল-

১। New Moon : শুরুর এ দশায় আমরা চাঁদকে দেখতে পারি না শুধুই অন্ধকার দেখা যায়। এ দশাকে আমরা অমাবস্যা বলে থাকি।
২। Waxing Crescent Moon : এ পর্যায়ে  কাচিঁর মত ছোট চিকন নতুন চাঁদ আমরা দেখতে পাই। ঠিক যেমন আমরা ঈদের চাঁদ দেখি। এ সময় চাঁদের বেশিরভাগ অংশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে।
৩। First Quarter Moon :  আমরা চাঁদের যে একপার্শ্ব দেখতে পাই এ দশায় তার প্রথম অর্ধেক আলোকিত হয়। অর্থাৎ পুরো চাঁদের প্রথম এক চতুর্থাংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে।
৪। Waxing Gibbous Moon : এ সময় চাঁদের অর্ধেকের বেশি অংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত হতে দেখি। এমন দেখলে বুঝতে হবে কিছুদিন পর পূর্ণিমা আসছে।
৫। Full Moon : এ সময় চাঁদকে আমরা পুরোপুরি আলোকিত দেখি যাকে আমরা, পূর্ণিমা বলি।
৬। Warning Gibbous Moon : এ দশায় চাঁদকে পূর্ণ চাঁদ থেকে সামান্য ছোট দেখা যায়।
৭। Last Quarter Moon : আমরা চাঁদের যে একপার্শ্ব দেখতে পাই এ দশায় তার শেষ অর্ধেক আলোকিত হয়। অর্থাৎ পুরো চাঁদের শেষ এক চতুর্থাংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে।
৮। Warning Crescent Moon : এ সময় চাঁদের আলোকিত অংশ একেবারে শেষের দিকে চলে আসে। কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ চাঁদ শেষ হয়ে আমরা আবার নতুন চাঁদ দেখতে পাব।

চাঁদকে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডেকে থাকি। যেমন- ব্লাক মুন, ব্লু মুন, সুপার মুন, ব্লাড মুন, মাইক্রো মুন। এখন আমরা এ সম্পর্কে জানব।

ব্ল্যাক মুন
ব্লাক মুন নামটা শুনে প্রথমেই মাথায় আসতে পারে চাঁদ আবার  কালো হয় নাকি? আসলে ব্লাক মুন বলতে চাঁদের রং বুঝানো হয়নি। এখানে ব্লাক মুন একাধিক অর্থ বহন করে। বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে ২৯.৫ দিনে চাঁদের একটি পূর্ণ চন্দ্রকলা সম্পন্ন হয়। আমরা জানি প্রতিমাসে একটি অমাবস্যা ও একটি পূর্ণিমা হয়। সে হিসাবে ২৯.৫ দিনের ব্যবধানে একটি পূর্ণিমা হয়। কিন্তু লিপ ইয়ার হয় ২৮দিনে। সেক্ষেত্রে ঐ ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ণিমা না’ও হতে পারে। এই পূর্ণিমা না হওয়াকে ব্লাক মুন বলা হয়। অর্থাৎ এখানে রং প্রকাশ করা হয়নি না’বোধক বুঝানো হয়েছে।

হোমওয়ার্ক সন্তানকেই করতে দিন ) 

ব্লু মুন
একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলে বুঝি ? ব্লাক, ব্লু এগুলো আবার কেমন চাঁদ। বিভ্রান্তি দূর করে চল আমরা জেনে নেই ব্লু মুন সম্পর্কে। ব্লু মুন কোন সাধারণ ঘটনা নয়।   সাধারণত মাসের ২য় নতুন চাঁদকে ব্লু মুন বলা হয়। মূলত ২ থেকে ৩ বছর পরপর ব্লু মুন দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত বছরে ১২ টি পূর্ণিমা হয়ে থাকে। তবে কোন কোন বছর এর থেকে বেশিও দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ঐ বিশেষ বছরের কোন এক মাসে একাধিক পূর্ণিমা চাঁদ দেখা যেতে পারে। এই অতিরিক্ত পূর্ণিমা চাঁদকে ব্লু মুন বলা হয়।

তবে চাঁদকে একবার নীল দেখা গিয়েছিল ১৮৮৩ সালের দিকে। এই লাইন পড়ার পর একটু নড়েচড়ে বসা স্বাভাবিক। কিন্তু কীভাবে? মূলত দেখা সম্ভব হয়েছিল একটা প্রাকৃতিক ঘটনার কারণে। ক্রাকাটোয়া নামক আগ্নেয়গিরি যখন বিস্ফোরিত হয়েছিল তখন র‍্যালে স্ক্যাটারিং তত্ত্ব অনুযায়ী ধূলিকণা বায়ুমণ্ডলে ফিল্টারের মত কাজ করতে শুরু করেছিল। এর ফলে তখন চাঁদ ও সূর্যকে নীল ও সবুজ বর্ণের দেখা গিয়েছিল। একইভাবে দাবানল ও ধূলিঝড়ের কারণেও চাঁদকে নীল দেখা যেতে পারে।

ব্লাড মুন
ব্লাড মুন বা রেড মুন নামের সাথে আমরা পরিচিত হলেও এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এমন নামকরণ করা হয়েছে মূলত পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের কারণে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবী চাঁদ ও সূর্যের মাঝে চলে আসে। অর্থাৎ এরা একই সরলরেখায় চলে আসে। এ সময় চাঁদে সূর্যের আলো পৌছাঁতে পারে না। কিন্তু সূর্যের আলো একেবারে পৌছাঁয়না এমনটা নয়, কিছুটা আলো বায়ুমন্ডলের সহায়তায় পরক্ষভাবে চাঁদে পৌঁছায়। এখানেও র‍্যালে স্ক্যাটারিং তত্ত্ব অনুসারে বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে প্রতিসরণের কারণে এই আলোর বিভিন্ন রকম আভার, যেমন লাল, কমলা, হলুদের সৃষ্টি হয়। ফলে আমরা চাঁদকে লাল দেখি।
রেড মুন নিয়ে কিছু কুসংস্কার রয়েছে। অনেকে মনে করেন রেড মুন হচ্ছে পৃথিবী ধ্বংসের সংকেত। অনেকে আবার মনে করেন এটি অশুভ শক্তির উদয়। অনেক হলিউড মুভিতেও এ সম্পর্কে দেখানো হয়েছে। এসব কুসংস্কারের কোন ভিত্তি না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এমন ভ্রান্ত ধারণা চলে আসছে।

কথা বলে লাইট জ্বালাতে চাও অদ্ভুত মাপজোখ বিজ্ঞানবাক্স হাতে নাও।

সুপার মুন
যে পূর্ণিমাতে চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে তাকে সুপার মুন বলা হয়। এ সময়ে চাঁদ অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি বড় ও উজ্বল দেখা যায়। পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩,৮৫০০০ কিলোমিটার হলেও সুপারমুনের সময় তা কমে ৫০,২০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে।

মাইক্রো মুন
সুপারমুনের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে মাইক্রোমুনের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এ সময় চাঁদ পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করে। ফলে চাঁদকে অন্য সনয়ের থেকে ছোট দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। মাইক্রোমুনের সময় গড় দূরত্ব  ৩,৮৫০০০ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ৪,০৫,৬৯৬ কিলোমিটারে পৌছাঁয়। খালি চোখে মাইক্রো মুন দেখা কিছুটা কষ্টসাধ্য।

সুপার ব্লু ব্লাড মুন
নাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে এটা কত জটিল। আগেই আমরা ব্লু মুন, ব্লাড মুন, সুপার মুন সম্পর্কে জেনেছি। এই সব গুলোর সম্মিলিত একটা রুপ হচ্ছে সুপার ব্লু ব্লাড মুন।  সুপার ব্লু ব্লাড মুন একটি বিরল ঘটনা। যখন মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করে এবং একই সাথে সেদিন চাঁদের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয় তখন তাকে সুপার ব্লু ব্লাড মুন বলে।
সর্বশেষ প্রায় দেড়শ (১৫০) বছর পর এমন চাঁদ দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। পূর্ব এশিয়া ও আমেকিরার প্রায় ৫০টি দেশে থেকে বিরল এই সুপার ব্লু ব্লাড মুন দেখা গিয়েছিল।

চাঁদ নিয়ে আজ এখানেই শেষ করছি। তবে পরবর্তীতে চাঁদ নিয়ে আরও কিছু বিষয় জানানোর চেষ্টা করব।

বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। 

 2,077 total views,  1 views today

What People Are Saying

Facebook Comment