স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এই কথাটি হয়ত এই মুহুর্তের চেয়ে ভালো করে কখনও আমরা বুঝি নি। পুরো পৃথিবীই বর্তমানে সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রোগ- ব্যাধি তখনই মহামারীর দিকে যায় যখন সেটা সংক্রমিত কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা জন জীবনে বহুলাংশে আঘাত করে। পৃথিবীতে কালে কালে এমন অনেক সংক্রমিত রোগ এসেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার বছর আগে এমন এক রোগের আবির্ভাব হয়েছিল। সবাই হয়ত নাম শুনে থাকবেন। রোগটির নাম কুষ্ঠ। এটি মানবসভ্যতার একটি প্রাচীনতম রোগ।দ
কুষ্ঠ একটি দীর্ঘমেয়াদী জীবাণুঘটিত সংক্রামক রোগ । মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি নামক জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়। এ রোগে মূলত প্রান্তিক স্নায়ু আক্রান্ত হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চামড়ার মাধ্যমে এ রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। চোখের পাতার মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে কুষ্ঠরোগীর দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগের বেশী কুষ্ঠরোগী উন্নয়নশীল দেশে দেখা যায়। সম্প্রতি প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ৩৫০০ জন নতুন কুষ্ঠরোগী সনাক্ত হয়ে আসছে।
অধিক জনসংখ্যা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ রোগটি ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৮০টি দেশে এ রোগের বিস্তার রয়েছে। ভারত, নেপাল, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, সোমালিয়া, লাইবেরিয়া ইত্যাদি দেশে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজার জনে ০.৬ জন এ রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বগুড়া ও ঢাকা জেলায় এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন এনজিও সমন্বিতভাবে কাজ করে চলেছে রোগটি নির্মূলের জন্য।
প্রকারভেদ
উপসর্গের উপর ভিত্তি করে কুষ্ঠ রোগ সাধারনত তিন রকম হতে পারে। যেমন- টিউবারকিউলয়েড কুষ্ঠ, লেপ্রোমেটাস কুষ্ঠ এবং বর্ডারলাইন কুষ্ঠ। আবার, আক্রান্ত অবস্থার উপর নির্ভর করে কুষ্ঠ রোগ সাধারনত দুই রকম হতে পারে। যেমন- পসিব্যাসিলারী এবং মাল্টিব্যাসিলারী । ত্বকের পাঁচ বা পাঁচের কম জায়গা আক্রান্ত হলে সেটা পসিব্যাসিলারী। অপরদিকে ছয় বা ছয়ের বেশি জায়গা আক্রান্ত হলে সেটা মাল্টিব্যাসিলারী।
লক্ষণ
সাধারণত যেসকল উপসর্গ দেখা দিলে সেটাকে কুষ্ঠ হবার সম্ভাবনা থাকে।
১। প্রথমত জ্বর, ব্যথা-বেদনা এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়।
২। রোগীর কানের লতি, মুখমণ্ডলসহ শরীরের অন্যান্য অংশে অনেক গুটি দেখা দেয়।
৩। দেহের কোন কোন স্থানের চামড়া মোটা হয়ে যায়।
৪। হাতে, পায়ে বা চোখের পাতায় দুর্বলতা অনুভূত হয়।
৫। চামড়ায় ফ্যাকাসে, লালচে অথবা তামাটে বর্ণের দাগ সৃষ্টি হয়।
৬। দাগ অনুভূতিহীন অথবা দাগে অনুভূতি কমে যেতে পারে।
৭। হাতে বা পায়ে অনুভূতিহীনতা বা ঝিনঝিন অনুভূতি।
৮। কখনও কখনও দাগ বা গুটির পরিবর্তে ত্বক মোটা হয়ে যায়।
কিভাবে ছড়ায়
মানুষকেই কুষ্ঠ রোগের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কুষ্ঠ রোগের জীবাণু সংক্রামক কুষ্ঠ রোগীর হাঁচি, কাশির মাধ্যমে বের হয়ে বাতাসে মিশে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সুস্থ লোকের দেহে প্রবেশ করে।
১। আক্রান্ত ব্যক্তির নাকমুখ দিয়ে ঝরা সর্দির মাধ্যমে
২। নিঃশ্বাসের সাথে এ রোগ ছড়াতে পারে।
৩। আক্রান্ত রোগীর স্পর্শের মাধ্যমে কুষ্ঠ রোগ চরাতে পারে। তবে সাধারণ মেলামেশায় এই রোগ ছড়ায় না।
৪। কুষ্ঠ রোগীর সাথে দীর্ঘ দিনের মেলামেশা এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এইও রোগ একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হয়।
৫। জীনগত কারণ অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণের জন্যে দায়ী হতে পারে এ সমস্ত রোগীর ক্ষেত্রে জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলে তাদের কুষ্ঠ রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
চিকিৎসা
নরওয়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডা. আরমান হ্যানসেন কর্তৃক ১৮৭৩ সালে কুষ্ঠ জীবাণু আবিষ্কারের ফলে কুষ্ঠ রোগের কারণ সম্পর্কে মানুষ নিশ্চিত হন। কিন্তু ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কুষ্ঠ রোগের কার্যকর চিকিৎসা মানুষের আয়ত্তের বাইরেই থেকে যায়। ১৯৬০ সালে মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী জন শেফার্ড ইঁদুরের দেহে কুষ্ঠ রোগের জীবাণুর বংশবিস্তার এবং এ রোগের কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার করেন। বর্তমানে কুষ্ঠ চিকিৎসায় ব্যবহৃত অত্যন্ত কার্যকর মাল্টি ড্রাগ থেরাপি এ আবিষ্কারেরই ফল, যা ১৯৮২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিটি উপজেলা স্বস্থ্যকেন্দ্র এবং বেসরকারী কুষ্ঠ ক্লিনিকে বিনামূল্যে আধুনিক সমন্বিত চিকিৎসা পাওয়া যায়। রোগের শ্রেণীভেদে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা ৬ মাস থেকে ১২ মাসের হতে পারে।
মহামারি হিসেবে কুষ্ঠ
প্রায় চার হাজার বছর পুরনো এই রোগে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে কোটি কোটি মানুষ। কুসংস্কার আর সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় রোগীরা হয়ে পড়ত একঘরে। ইউরোপে এই রোগের প্রার্দুভাব ছিল সবচেয়ে প্রকট। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে কুষ্ঠ রোগের যখন টিকা আবিষ্কার হলো এরপর থেকেই মানুষ এই রোগের থেকে মুক্তি পেতে থাকে।
কুষ্ঠ মিথ
অঞ্চলভেদে এই রোগ নিয়ে অনেক ধরনের কুসংস্কার শোনা যায়। এসব কুসংস্কারের কারণে রোগীরা সমাজে নিগ্রহের শিকার হত। বিশ্বাস করা হত যে এই রোগ তাদেরই যারা বেশি পাপ করে এবং এটা বংশগত। এসব ধ্যান ধারনা একেবারেই ভুল এবং ভিত্তিহীন। যেকারোরই এই রোগ হতে পারে। তবে ২০-৪০ বছরের মানুষের এই রোগের ঝুঁকি বেশী থাকে। পরিপূর্ন চিকিৎসা সেবা পেলে এই রোগ পুরোপুরি সেরে যায়।
সমাজ থেকে এই কুসংষ্কার দূর করার জন্য দি লেপ্রসী মিশন জনগনের মাঝে স্বাস্খশিক্ষা প্রদান করে জনগনের সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে স্বাস্থ শিক্ষা বিষয়ক উপকরণাদি সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে জনগণ সচেতন হয়ে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হচ্ছে।
শত শত বছর ধরে যেসকল সংক্রমিত রোগ মহামারী আকারে পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণ নিয়েছে আমরা ধারাবাহিক ভাবে এইসকল রোগ নিয়ে আপনাদের সামনে রোগের ইতিহাস ,কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার তুলে ধরবো। সামনের পর্বে তেমনই এক রোগ নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
939 total views, 1 views today