বেশ কিছু মেধাবী বিজ্ঞানী জন্ম নিয়েছেন আমাদের দেশেই। তাদের মধ্যে জগদিশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, জামাল নজরুল ইসলাম সহ রয়েছেন আরো অনেকে। সারাবিশ্বে বিজ্ঞানের সমৃদ্ধিতে অবদান রয়েছে আমাদের দেশী অনেক বিজ্ঞানীর। এর আগে আমরা বিজ্ঞানবাক্স ব্লগে জগদিশ চন্দ্র বসু, আবদুল্লাহ আল মুতী, আজম আলী সহ অনেকের সম্পর্কে জেনেছি। চলো আজকে জেনে নেই জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে।
পড়ালেখা
জামাল নজরুলের বাবা চাকরি করতেন কলকাতায়। জামাল নজরুল কলকাতার একটা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে তার বাবা-মায়ের সাথেই চলে আসেন চট্রগ্রামে। চট্রগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু তার মেধা আর বুদ্ধি দেখে স্যাররা তো অবাক বনে যান। সেজন্য তাকে সরাসরি ভর্তি করে নেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। এখানে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন, পরে পশ্চিম পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ সম্পন্ন করেন থেকে এ’লেভেল ও ও’লেভেল। এরপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেন।এরপর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক থিউরিটিক্যাল ফিজিক্স’-এ পিএইচডি সম্পন্ন করেন। উনি কিন্তু মাত্র বিশ বছর বয়সে দু-বার বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।দ্বিতীয়বার বিএসসি করেন লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে। ডক্টরেট ডিগ্রি করার সময়ও চতুর্থ শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার মতো উনি আগেই শেষ করে ডাবল প্রমোশন পেয়ে পোস্ট ডক্টরেট করার সুবিধা পান। এরপর তিনি ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রীও অর্জন করেন। এই ডিগ্রী কেবল তাদেরই দেয়া হয় যারা বিজ্ঞানে বিশেষ কোন অবদান রাখেন।
বই ও গবেষণা
লন্ডনের রয়েল সায়েন্স একডেমি, যেখান থেকে বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীদের গবেষণা পত্র প্রকাশ হয়। সেখান থেকেই নজরুল স্যারের পর পর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো। পরে সেই গবেষণাপত্র গুলোকে একত্র করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রকাশনী থেকে ‘অন রোটেটিং চার্জড ডাস্ট ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামক বই প্রকাশ করেন। বইটিতে আপেক্ষিক তত্ব ও চার্জিত বস্তুর সম্পর্ক নিয়ে লেখা রয়েছে।
কিন্তু মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি ও ব্লাক হোল নিয়ে লেখা ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত তার প্রথম বই ‘দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ সারা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দেয়। বইটি ফরাসি, জাপানী, পর্তুগিজ, ইতালিয়ানসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তাছাড়া ‘এন ইন্ট্রোডাকশন অব ম্যাথমেটিকেল কসমোলজি’-সহ তাঁর আরও অনেক বই রয়েছে যা ক্যামব্রিজ সহ পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়।
তাছাড়া তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য আমাদের উৎসাহ দিয়ে গেছেন। লিখেছেন ব্ল্যাকহোলের মত জটিল বিষয় নিয়ে ‘কৃষ্ণ বিবর’ নামে বাংলা ভাষার বই। তোমরা যারা বড় হয়ে গবেষক হতে চাও তাদের জন্য লিখেছেন ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য’ ও ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’। তাছাড়া বাংলা একাডেমি থেকে তিনি লিখেছেন ‘ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা’ নামে দারুন এক সিরিজ।
জামাল নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ, প্রিন্সটনের ইনস্টিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, প্রিন্স কলেজ অব লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফ, সিটি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন। কতগুলো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলে ফেললাম! কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আমাদের জামাল নজরুল স্যার এই সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। আরো অবাক করা বিষয় হলো, ১৯৮১ সালে সবশেষে উনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন আমাদের চট্রগ্রামে। বাংলাদেশের মানুষকে বিজ্ঞান পড়াবেন বলে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজকীয় জীবন ছেড়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি পড়িয়েছেন মাত্র ২৮০০ টাকা বেতনে। বেতন ওনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। উনি বলেন, আমি বাংলাদেশকে দিতে এসেছি, এখান থেকে নিতে না।
১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানীরা আমাদেরকে অত্যাচার করছিলো, অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছিলো আমাদের ওপর তখন জামাল নজরুল স্যার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন পাকিস্তানীদের নির্যাতন বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আমাদের জাফর ইকবাল স্যার বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেশে আসার আগেও জামাল স্যারেরই পরামর্শ নিয়েছেন।
দেশকে এতটাই ভালোবাসতেন আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম স্যার
অনেকটা প্রচার বিমুখ এই মেধাবী দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানী ১৯৮৪ সালে ক্যাম্ব্রিজের সমৃদ্ধ জীবন ছেড়ে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, অনেক তরুনকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন গবেষক হতে। সেটার জন্য চাননি কোন প্রতিদান। ওনাকে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব দিতে চাইলে উনি বলেছেন “আমার চায়ের কাপ থাকবে গবেষণাগারে, প্রশাসনিক ভবনে নয়”। ২০১৩ সালের ১৬-ই মার্চ এই মহান বিজ্ঞানী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ওপারে। মহান মানুষরা মরেন না। জামাল নজরুল স্যার তোমাদের জন্য যে অনুপ্রেরণা রেখে গেছেন সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে তোমরা যতবার গবেষক হতে চাচ্ছো, স্বপ্ন লালন করছো ততবারই তোমাদের মাঝেই জন্ম নিচ্ছে একজন জামাল নজরুল ইসলাম।
তথ্যসূত্র-বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
2,364 total views, 1 views today