স্কুল নিয়ে কিছু কিছু বাচ্চাদের দীর্ঘমেয়াদী ভীতি তৈরি হতে পারে। একে স্কুলভীতি, স্কুল এড়িয়ে চলা, স্কুল রিফিউজাল ইত্যাদি বলে। সাধারণত ৭–১১ বছর বয়সী বাচ্চার ক্ষেত্রে এই সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। স্কুল ফোবিয়ায় (School phobia) আক্রান্ত বাচ্চারা অনেক বেশি স্পর্শকাতর এবং আবেগি। তারা সাধারণত তাদের মা-বাবার কাছে থাকতে চায়। এবং স্কুলে যাবার কথা ভাবলে তারা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরার ভয়ে থাকে। তাদের এই ভীতি তাদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমনঃ মাথা ব্যথা, বমি, পেট ব্যথার কারন হতে পারে। স্কুল ফোবিয়া বাচ্চাদের পড়াশোনার উপর মারাত্বক প্রভাব ফেলতে পারে। কম করে হলেও ৫% বাচ্চারা স্কুল ফোবিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে।
শিশুরা বিভিন্ন কারনে স্কুল ফোবিয়াতে (School phobia) আক্রান্ত হতে পারে, আসুন কারণগুলো জেনে নিনঃ
১। নতুন পরিবেশ
অনেক বাচ্চারা নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। তারা নার্ভাস বোধ করে এবং স্কুলে যেতে চায়না। হঠাৎ করে বাচ্চারা যখন পরিবার থেকে আলাদা হয়ে স্কুলের নতুন পরিবেশে গিয়ে পড়ে, তারা তখন ঘাবড়ে যায়। আর এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাকে আগে থেকেই স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে অভিহিত করা।
২। পারিবারিক সমস্যা
অনেক শিশু পারিবারিক সমস্যা বা অন্য কোন কষ্টকর অভিজ্ঞতার জন্যে স্কুল বিমুখ হতে পারে। পারিবারিক সমস্যাগুলো বাচ্চার কচিমনে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। এবং এ থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। এছাড়াও স্কুলে যাবার জন্য যদি বাচ্চাকে জোর করা হয় কিংবা মারধর করা হয়। তাও বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
৩। অতি রক্ষণশীল মা–বাবা
একজন মা তার বাচ্চার প্রথম শিক্ষক। স্বাভাবিক ভাবে মা-বাবারা অনেক বেশি যত্নশীল হয়। কিন্তু অনেক বেশি যত্নশীল হতে যেয়ে মা-বাবারা বাচ্চার শেখার সামর্থ্য কমিয়ে দিতে পারে। বাচ্চাকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে মা-বাবা যদি বাচ্চার সব পদক্ষেপে সাহায্য করে, তবে বাচ্চা শিখবে কিভাবে। যখন স্কুলে অনেক শিশুদের শেখানো হয় তখন এই শিশুরা নিজেদের অবহেলিত মনে করে এবং মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এই জন্যে তারা স্কুল বিমুখ হয়ে উঠতে পারে।
৪। আলাদা হওয়ার ভয়
অনেক শিশু তাদের মা-বাবার কাছ থেকে দূরে থাকার ভয়ে অনেক সময় স্কুলে যেতে চায় না। প্রাথমিক অবস্থায় একটি বাচ্চা তার নিজস্ব গণ্ডির মাঝে পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠে। এবং হঠাৎ করে তাকে যখন সম্পূর্ণ অচেনা একটা পরিবেশে অনেকক্ষন সময় অতিবাহিত করতে হয়, তখন সে স্বাভাবিক ভাবেই ঘাবড়ে যায়। শিশুরা অনেক সময় অনেক মানুষ দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারে। আর তাইতো বাচ্চাকে আগে থেকেই স্কুল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে এবং তার মা-বাবা যে তার আশেপাশেই আছে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
৫। যাতায়াত ব্যবস্থার দুরবস্থা
যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হলে বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায়না। ভ্যান অথবা বাসে অনেক বেশি ভিড় হলে বাচ্চারা স্কুলে যাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও স্কুলের অবস্থান অনেক দূরে হলে এবং যাতায়াতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হলে বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এবং এই অজুহাতে অনেক বাচ্চাই স্কুলে যেতে চায়না কিংবা গ্যাপ দেয়। ফলে তারা তাদের পড়াশোনায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
৬। পরীক্ষার ভয়
অনেক বাচ্চাই পরীক্ষাকে ভয় পেতে পারে। কারণ ফলাফল খারাপ হলে মা-বাবা, শিক্ষকরা রাগ করতে পারে। এমনকি সহপাঠীরা অবজ্ঞা করতে পারে। এটা বাচ্চাদের বড় হয়ে উঠার সময় খুব কমন একটা বিষয়। এই ভয় অনেক বিপদজনক হয়ে আসে এবং এর ফলে সে মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৭। হোমওয়ার্ক এবং এ্যাসাইনমেণ্টের ভয়
অনেক সময় বাচ্চারা হোমওয়ার্ক এবং এ্যাসাইনমেণ্ট করতে ভুলে যায় বা করতে পারে না। এতে তারা স্কুল টিচারদের ভয়ে থাকে। স্কুল জীবনে এগুলো অনেকেরই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে থাকে। এগুলো থেকে বাঁচতে বাচ্চারা স্কুল ফাঁকি দিতে থাকে। আর তাই অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাদের পড়াশোনার বিষয়ে খোঁজ খবর রাখা এবং হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করা।
৮। শিক্ষকদের খারাপ আচরণ
মাঝে মাঝে বাচ্চারা শিক্ষকদের ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না। যদিও শিক্ষকরা আগের মত বেতের ব্যবহার বা শারীরিক প্রহার করেন না। তবুও শিক্ষকদের সম্পর্কে শিশুদের মনে ভয় রয়ে গেছে। কিছু কিছু শিক্ষকদের খারাপ আচরণ বাচ্চাদের স্কুল বিমুখ করে দিতে পারে।
৯। সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হলে
শৈশবকালে কোন বাচ্চা যখন কোন ভাবে সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হয়, তখন সে ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। সে মানসিক ভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। স্কুলে কোন ভাবে কারও দ্বারা যদি সে এই নোংরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন তার মনে বিশাল ভয় জমা হয়। সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ে।
১০। বিদ্রুপমূলক আচরণের স্বীকার হলে
অনেকসময় স্কুলের শিক্ষক এবং সহপাঠীদের বিদ্রুপমূলক আচরণের কারণে বাচ্চার মধ্যে স্কুলভীতি তৈরি হয়। ছোট বাচ্চারা সংবেদনশীল হয়ে থাকে এবং তাদেরও ভীষণ অপমানবোধ থাকে। আর এক্ষেত্রে তারা যখন বুলিংয়ের শিকার হয়। তখন তারা অপমানিত বোধ করে এবং ভীষণ কষ্ট পায়। এবং যার ফলে স্কুল হয়ে উঠে তাদের জন্য বিভীষিকাময়!
স্কুল-বুলিংয়ের (School Bullying) অপছায়া দূর হয়ে শিশুর স্কুল আনন্দময় হোক!
অভিভাবকগণ এবং শিক্ষকরা যেসব কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে বাচ্চাদের স্কুলভীতি (School phobia) দূর করতে পারেন। আসুন জেনে নিন কিছু উপায়ঃ
১। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া
শারীরিকভাবে বাচ্চা কোন রোগে আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করা জরুরী। অনেক সময় আবার শরীরের থেকে মনের সমস্যাই অনেক বড় হয়ে দাড়ায়। আর তাইতো দরকার হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও নিয়ে যেতে হবে। এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে এবং দরকার হলে কাউন্সেলিং করতে হবে। এতে দ্বিধা করার বা লজ্জা পাবার কিছু নেই। শরীরের সুস্থতা যেমন প্রয়োজন তেমনি মানসিক সুস্থতাও অনেক জরুরী বিষয়।
২। বাচ্চার কথা শুনতে হবে
বাচ্চারা অনেক সময় অনেক সমস্যা লুকায় এবং ভীত থাকে বলে সাহসের অভাবে বলতে পারে না। তার স্কুলে অবস্থাকালীন সময়ে কোন সমস্যা হয় কিনা, তা বন্ধুর মত মিশে তার কাছ থেকে শুনতে হবে। স্কুলে সে কোন ভাবে সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের স্বীকার কিনা তাও জানতে হবে এবং এ ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩। স্কুলের শিক্ষকসহ অন্যদের সাথে কথা বলা
স্কুলে বাচ্চার কি সমস্যা হচ্ছে তা তো আপনি ঘরে বসে জানতে পারবেন না। আর তাইতো স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে সাহায্য নিন। এছাড়াও স্কুলের অন্যান্য স্টাফদের সাথেও কথা বলে বাচ্চার সমস্যা চিহ্নিত করুন। এবং আপনার সন্তান যে সমস্যা ফেস করছে তা সমাধান করতে উদ্যোগী হন। তবে খেয়াল রাখবেন তা যেন আপনার বাচ্চার জন্য হিতে বিপরীত না হয় এবং সে যেন এতে অপমানিত বোধ না করে।
৪। স্কুল এবং বাসার পরিবেশের মাঝে সামঞ্জস্য করা
স্কুলে বাচ্চা যাতে আরামদায়ক পরিবেশে নির্ভাবনার সাথে পড়াশোনা করতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। স্কুল মানেই ভীতিকর জায়গা নয়, আর স্কুলে শারীরিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক আগেই। আর বর্তমানে স্কুলগুলোতে অনেক আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও যদি আপনার সন্তান কোন ক্ষেত্রে মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়। তবে সেক্ষেত্রে আপনি স্কুল কর্তৃপক্ষকে অভহিত করতে পারেন।
৫। স্কুলের বিভিন্ন কাজে বাচ্চাদের যুক্ত করা
সব বাচ্চা হয়তো নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারে না। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের উচিত বাচ্চার প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করা। আর এক্ষেত্রে স্কুলের বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম এবং ভলেন্টিয়ারি কাজে বাচ্চাদের নিযুক্ত করা। এক সাথে অনেক বাচ্চা খেলাধুলা করতে করতে বন্ধুত্ব হয়ে যাবে। এবং এক সময় বিভিন্ন ভলেন্টিয়ারি কাজে ব্যস্ত হলে, কোন বাচ্চার যদি স্কুলভীতি (School phobia) থাকে তবে তা আস্তে আস্তে কমে যাবে।
৬। বাচ্চাদের বিভিন্ন সমস্যার সাথে ডিল করা শেখাতে হবে
বাচ্চার সব সমস্যা যদি আপনিই সমাধান করে দেন, তবে সে পরনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবে। আর তাই বাচ্চাকে তার সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে সাহায্য করুন। বাচ্চাকে সাপোর্ট করুন ঠিক আছে, তবে তাকে সমস্যা মোকাবেলার উপযুক্ত করে গড়ে তুলুন।
৭। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইক্রিয়াটিস্ট নিয়োগ
শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও কম বড় নয়। স্টুডেন্টদেরকে মানসিক ভাবে ভালো রাখতে, প্রত্যেক স্কুলে একজন করে সাইক্রিয়াটিস্টের নিয়োগ দেয়া উচিত। সে প্রত্যেক বাচ্চাকে আলাদা আলদা ভাবে কাউন্সেলিং করবে। এবং প্রত্যেক মাসে বাচ্চা, অভিভাবক এবং শিক্ষকসহ সবার সাথে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আলোচনা করবে। এবং এই ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে যে সমাধান আসবে তা সবার জন্যই মঙ্গল ডেকে আনবে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,740 total views, 1 views today