[emaillocker]
যদি কেউ লক্ষ্য ঠিক করে যে, একদিন মঙ্গলে হবে তার বসতি। মঙ্গলে কোনো এক ঘরে এক কাপ কফি খেতে খেতে মৃত্যু হবে তার। তবে তাকে অবশ্যই আপনি পাগল ভাবতে পারেন কিংবা গাল গপ্প ও বলতে পারেন। কিন্তু আপনার ভাবনার এই গাল গপ্প ও পাগলামিকে বাস্তবে পরিণত করতে কাজ করে যাচ্ছেন ‘ইলন মাস্ক’ নামের একজন। ইলন মাস্ক, এতোদিনে হয়তো এই নামটি কোন ভাবে আপনার কানে এসেছে। আর যারা এই নামটি শুনেননি, তাদের জন্যই আজকের আয়োজন!
ইলন মাস্ক পৃথিবীকে বদলে দিতে যিনি একাই কাজ করে যাচ্ছেন। অনলাইন ট্রানসেকশন, ইলেকট্রিক গাড়ি ও মহাকাশযান- এই তিন ইন্ডাস্ট্রিকে বদলে দেওয়া স্বপ্নবাজ মানুষটির সবচেয়ে বড় স্বপ্ন একদিন মঙ্গলে হবে তাঁর বসতি। মঙ্গলে কোনো এক ঘরে এক কাপ কফি খেতে খেতে মৃত্যু হবে তাঁর। কেমন অবিশ্বাস্য ও পাগলাটে কথাবার্তা তাইনা। চলুন তার সম্পর্কে জেনে আসি।
কে এই ইলন মাস্ক?
ইলন মাস্ক একজন সফল উদ্যোক্তা। যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। পে-প্যাল, টেসলা মটরস সহ স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজি(SpaceX), জিপ২(zip2) এবং সোলার সিটির(SolarCity) কোফাউন্ডার। একই সাথে ওপেন এ.আই(OpenAI) এর কো-চেয়ারম্যান।
জন্ম ও বেড়ে উঠা
পুরো নাম ইলন রীভ মাস্ক। জন্মেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়, ১৯৭১ সালের ২৮ জুন। দক্ষিণ আফ্রিকান পিতা এবং কানাডিয়ান মায়ের ছেলে ইলন মাস্কের ছেলেবেলা কাটে তার ভাই কিম্বাল এবং বোন টস্কার সাথে। নয় বছর বয়সে যখন প্রথম কম্পিউটার হাতে পান, সেটির মেমরি ছিল ৫ কিলোবাইট। How to Program গাইড মাত্র তিনদিনে আত্মস্থ করে ছোট্ট মাস্ক একটা ভিডিও গেম বানিয়ে ফেললেন ‘ব্লাস্ট’ নামে, যেটা তার মতে- ফ্ল্যাপি বার্ডের চেয়ে বহুগুণে ভাল। ১৯৮৩ সালে গেমটি ৫০০ ডলারে কিনে নিয়েছিল একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিন যখন মাস্কের বয়স মাত্র ১২।। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নিজের বানানো গেম বিক্রি করে তার জীবনের প্রথম আয় ৫০০ ডলার। শেখার আগ্রহ ছিল প্রচুর। দিনে ১০ ঘন্টার উপরে বই পড়তেন। পড়ার ধাত এতোই বেশি ছিল যে লাইব্রেরীর সব বই শেষ করে পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাই পড়ে ফেললেন।
১৭ বছর বয়সে ইলন মাস্ক কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে কুইনস ইউনিভার্সিটিতে কয়েক বছর পড়ালেখা করে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় ভর্তি হন। সেখান থেকে অর্থনীতি ও পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন। পড়ালেখা শেষ করে মাস্ক তাঁর উদ্ভাবনের নেশায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
আরও পড়তে পারেন- ‘জগদীশ’- একজন মহান বিজ্ঞানী, এবং একজন বাংলাদেশী
স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মাস্কের মাথায় ৫ টি বিষয় নিয়ে খেলা চলছিল যা তার মতে ভবিষ্যতের নিয়ামক হতে পারে ইন্টারনেট, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, মহাকাশে বিস্তার, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং জেনেটিক কোড পরিবর্তন প্রক্রিয়া। তবে মাস্ক নিজের জন্য ইন্টারনেটকেই প্রথমে বেছে নেন। তাঁর ভাই কিম্বাল মাস্ককে নিয়েই প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের একটি কোম্পানি জিপ২(zip2)। জিপ২ একটি ওয়েব নির্ভর সফটওয়ার কোম্পানি যার কাজ ছিল ইন্টারনেটে একটি বিজনেস ডিরেক্টরি ও ম্যাপ তৈরি করা। সেই সময়ে ব্যাবসায়ীরা ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে পয়সা খরচ করাকে বোকামি মনে করত, কিন্তু ধীরে ধীরে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে জিপ২ ও ফুলে ফেঁপে উঠল। বিশ্বখ্যাত কোম্পানি কমপ্যাক জিপ২ কে ১৯৯৯ সালে ৩০৭ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। নিখুঁত ভবিষ্যতদ্রষ্টা মাস্ক মাত্র ২৭ বছরেই হন মিলিওনিয়ার।
‘পেপ্যাল’ তৈরি
মাস্ক এরপর ইন্টারনেটে বেঁচাকেনা, টাকা আদানপ্রদানের সুবিধার জন্য একটা ওয়েব ব্যাঙ্ক এর আইডিয়া নিয়ে উঠেপড়ে লাগেন। জিপ২ থেকে পাওয়া অর্থের তিন চতুর্থাংশই বিনিয়োগ করেন তার নতুন আইডিয়ার পেছনে। তৈরি হয় এক্স.কম (X.com)। সেটিকে আরেক প্রতিষ্ঠান কনফিনিটির সঙ্গে একীভূত করে তৈরি করেন ‘পেপ্যাল’। ভার্চুয়াল ওয়ালেটের উৎপত্তি এ পেপ্যালের হাত ধরেই। ২০০২ সালে কোম্পানিটি eBay এর কাছে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দেন। বলা হয়, আজকের অনলাইন দুনিয়ার ইন্টারনেট পেমেন্টের পদ্ধতি মূলত এই প্রযুক্তিবিদের মস্তিষ্ক থেকেই এসেছে।
মহাকাশ স্বপ্ন
ছেলেবেলার দেখা স্বপ্নের উপর ভর করে তখনো তাঁর ভালোবাসার জায়গা ছিলো পরিবেশ এবং মহাকাশের উপরে। সেই স্বপ্নের পথ ধরেই ২০০২ সালে তিনি স্পেসএক্স(spacex) নামে একটি কোম্পানি গড়ে তুলে মহাকাশ গবেষণায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করেন। স্পেসএক্স বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র কোম্পানি যারা তুলনামূলক খুবই কম খরচে মহাকাশে পাঠানো সম্ভব এমন রকেট তৈরি করছে এবং সেই রকেটের এক্সপ্লোরেশন থেকে রিকোভার পর্যন্ত যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০০৮ সালে বিশ্বের প্রথম কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে মহাকাশে সফল রকেট উৎক্ষেপণ করে স্পেসএক্স। মহাকাশ পর্যটন নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই এলন মাস্কের। আগামী ১২ বছরের মধ্যেই মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন করতে চান তিনি। সেখানে একটি শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্পেসএক্স কাজ করছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বছরই একটি রকেট যাবে মঙ্গল গ্রহে। এ ছাড়া স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেও কাজ করছেন তিনি।
পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী
২০০৪ সালে ৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন ইলেক্ট্রিক অটোমোবাইল কোম্পানি টেসলাতে। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তেল ও গ্যাসের উপর চাপ কমিয়ে আনা। লক্ষ করুন, তার দ্বিতীয় চিন্তাটি ছিল পরিবেশবান্ধব জ্বালানি নিয়ে! এবং ২০০৬ সালে তার কাজিনের সাথে মিলে গঠন করে আরেকটি কোম্পানি ‘সোলার সিটি’। এটির লক্ষ্য সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘরদোরের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ যা ফুয়েলের মাধ্যমে তৈরি করা হয়, তার পরিমাণ কমিয়ে আনা। এর মাধ্যমে তিনি চেয়েছেন তার পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি ধারণার আরো বিস্তার ঘটাতে।
পথটা এতোটা মসৃণ ছিলোনা
২০০২ থেকে ২০০৮ সাল এলন মাস্কের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। কারন তার তিন-তিনটি সিদ্ধান্তই ছিল সময়ের তুলনায় অনেক বেশী এগিয়ে, যা শুধু কল্পনা করা যায়। এসময় স্পেসএক্স এর তিনটি রকেট কক্ষপথে পৌঁছনোর আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিফলতার সময়ে বাইরে থেকে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইছিল না। তবু মাস্ক হাল ছাড়েননি। তিনি বলেছিলেন- ‘আমার কাছে যা আছে তা দিয়ে হয়ত আরো একটি রকেট পাঠানো যাবে, এবং আমি সুযোগটি নিতে চাই’। তখন অন্য প্রতিষ্ঠান টেসলার অবস্থাও খুব খারাপ কোন বাড়তি বিনিয়োগ নেই। আমেরিকা সহ সারা বিশ্বে তখন অর্থনৈতিক ধ্বস। অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি দেউলিয়া হওয়ার মুখে। পত্র-পত্রিকায় টেসলা কে বলা হচ্ছিল ২০০৭ এর সবচেয়ে ব্যর্থ টেক কোম্পানি! কিন্তু মাস্ক ঘুরে দাঁড়ালেন ২০০৮ এর শেষে। স্পেসএক্সে তার চতুর্থ ও শেষ চেষ্টা সফল হল। রকেট ঠিকঠাক কক্ষপথে পৌঁছুল। পরবর্তীতে নাসা পর্যন্ত ১.৬ বিলিয়ন ডলারের কন্ট্রাক্ট করল স্পেসএক্সের সাথে তাদের পরবর্তী ১২ টি রকেট উৎক্ষেপনের জন্যে। স্পেসএক্স ভালভাবেই দাঁড়িয়ে গেল।
২০০৮ থেকে এখন পর্যন্ত ইলন মাস্কের সবকটি প্রোজেক্টের উন্নতির গ্রাফ উপরের দিকে। স্পেসএক্স এখন পর্যন্ত ২০ টির উপর রকেট উৎক্ষেপন করেছে যার প্রত্যেকটিই সফল। নাসা তার নিয়মিত গ্রাহক। দারুন খবর হল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছিল ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি।
আর টেসলাতেও বিনিয়োগ আসা শুরু করল। বাজারে আসল নতুন গাড়ি। ন্যাশনাল হাইওয়ে সেফটি এডমিনিস্ট্রেশন এর রেটিং এ ৫/৫ পেয়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয় টেসলার গাড়ি। আর সোলার সিটি এখন আমেরিকার সর্বাধিক সোলার প্যানেল সরবরাহকারী কোম্পানি। তারা এখন আমেরিকার সর্ববৃহৎ সোলার প্রস্তুত কারখানা বসাচ্ছে বাফালোতে। এবং এই তিন কোম্পানি মিলে কর্মীর সংখ্যা ত্রিশ হাজারেরও বেশি!
আরও পড়তে পারেন- ‘মেডিটেশন’ বদলে দিবে শিশুর ভবিষ্যৎ
প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে
পে-প্যাল, সোলারসিটি, স্পেসএক্স, টেসলা –একজন মানুষের পক্ষে এতো বড় ও ভিন্ন ভিন্ন প্রোজেক্ট নিয়ে একসাথে কাজ করা কিভাবে সম্ভব? কি করে তিনি সামলান এতো বড় বড় কোম্পানি? আপাতত মাস্ক পড়ে আছেন তার রকেটযাত্রা ও টেসলার কাজ নিয়েই। সোমবার যান লস অ্যাঞ্জেলস এ SpaceX এর তদারকিতে। মঙ্গল আর বুধবার তোলা থাকে Tesla’র জন্যে। বৃহস্পতিবার আবার SpaceX। শুক্রবারটা অর্ধের করে ভাগাভাগি করে নেয় দুটো কোম্পানি। দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। মাস্ক বিশ্বাস করেন তিনি Biological Barrier ভাঙতে পেরেছেন। একসাথে অনেকগুলো কাজ তিনি সমন্বয় করতে পারেন। নিজেকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিয়ে নিজের সর্বোচ্চটাই বের করে আনেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
[/emaillocker]
1,240 total views, 1 views today