ছোটবেলায় বিটিভিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখতাম আর ভাবতাম এরা এত এত জানে, এত সুন্দর করে কথা বলে, এত সুন্দর পাল্টা যুক্তি দেয়! আমিও এদের মতো হবো।আমিও এমন বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মত তুলে ধরবো। এরপর বড় হয়ে হাইস্কুলে ও কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করেছি। একাডেমিক পড়ালেখা আমার কাছে কিছুটা বিরক্ত লাগতো। তবে বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য নিজে নিজে পড়তাম তুমুল আগ্রহ নিয়ে। জানুয়ারির নতুন ক্লাসের আমুদে দিন আর ফেব্রুয়ারীর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পরই শুরু হতো আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এই সময়ে আমি বেশ আনন্দ নিয়েই পড়তাম। অনেক মানুষের সামনে নিজেকে ও নিজের মতকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা, চিন্তার ও জানার পরিধি বাড়ানো ইত্যাদিতে বিতর্ক আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। বড় হওয়ার পরতো ধীরে ধীরে জানতে পারলাম বিতর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু স্কুল কলেজের এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে না! বিতর্ক বিস্তৃত রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে উন্মুক্ত বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয় অনেক দেশেই। আমেরিকাসহ অনেক উন্নত দেশেই নির্বাচনে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণেও উন্মুক্ত বিতর্কের আয়োজন হয়। অনেক গুণী মানুষতো বিতর্ককে শিল্প হিসেবেই দেখেন। গ্রীক সভ্যতা থেকে শুরু করে দু-হাজার বছর পরেও যে মাধ্যমটার এত গুরুত্ব তা শিল্পতো হবেই।
বিতর্ক নিয়ে অনেক কথা হলো। বিতর্ক নিয়ে এমন অভিজ্ঞতা আপনারও আছে। কিন্তু বিতর্কের যে এত এত গুণ, সেটা কীভাবে সন্তানের মাঝে গড়ে উঠে! আমাদের আজকের লেখার বিষয় এটাই। আপনার সন্তান যদি স্কুল বা কলেজে বিতর্কের সাথে যুক্ত থাকে তাহলেতো আপনি ইতোমধ্যে জানেন, বিতর্ক তাকে কতটা স্মার্ট ও চিন্তাশীল করেছে। আর যদি যুক্ত না থাকে তাহলে এই ব্লগ পড়ার পরে আপনি আপনার সন্তানকে বিতর্কে যুক্ত করার কথা ভাববেন।
গুছিয়ে কথা বলতে শেখা
বন্ধু কিংবা পরিবারের সবার সাথে আমরা আমাদের কথাগুলো ও মতামত সাবলীল ভাবেই বলে ফেলতে পারি। কিন্তু যখনই পাবলিক স্পিকিং এর বিষয় আসে, অনেক মানুষের সামনে কোন নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনই আমাদের ভেতর কোথা থেকে যেন বাক্সভর্তি জড়তা চলে আসে। মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায় না, বুক ধড়পড় করে, নার্ভাস লাগে, কথা কোনভাবে বের হলেও তা গোছালো হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অনেক মানুষের মাঝে বড় বয়সেও এমন সমস্যা দেখা যায়। তবে ছোটবেলায় যারা নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতার সাথে যুক্ত ছিলো তারা কিন্তু এই সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আপনার সন্তান যদি ছোটবেলা থেকেই বিতর্কের সাথে যুক্ত থাকে তাহলে সে ধীরে ধীরে এই সমস্যা থেকে উতরে যেতে পারবে। গুছিয়ে কথা বলা, উপস্থিত সবার মনোযোগ নিজের দিকে রাখা, নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে সুন্দরভাবে অন্যের কাছে তুলে ধরা; এমন অসাধারণ গুণগুলো তার ভেতরে বিকশিত হবে ধীরে ধীরে। যা তার সারা জীবনের সম্পদ হিসেবে তাকে সর্বক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
জানার পরিধি সমৃদ্ধ হওয়া
বিতর্কে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি দল থাকে। তাদের নিজেদের পক্ষের বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য প্রচুর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। ফলে যারা নিয়মিত বিতর্কের সাথে যুক্ত থাকে, ধীরে ধীরে তাদের জানার পরিধি, জ্ঞানের ভান্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতে থাকে। শুধু সমৃদ্ধ না, বিতর্কের ক্ষেত্রে তার জানাটাও হতে হয় সঠিক। একজন বিতার্কিক মাত্রই জানে কোন তথ্য ভুল দিলেই তা ধরার জন্য বিচারকরা আছেনই। ফলে বিতর্ক নিয়ে জানতে গিয়ে তার জানাটা হয় একেবারেই পরিপূর্ণ। তাহলে একবার ভাবুনতো, কেউ যদি তার স্কুল জীবনে টানা পাঁচ বছরও বিতর্কের সাথে যুক্ত থাকে তাহলে তার জ্ঞানের পরিধি কতটা সমৃদ্ধ হবে? মজার বিষয় হচ্ছে, তার এই জ্ঞানভান্ডার তার সামনের দিনগুলোতে তাকে সাহায্য করে নানা ভাবে। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে চাকরির ইন্টারভিউ সহ জীবনের নানান সময়ে সে তার এই জ্ঞান ভান্ডারের সুফল লাভ করবে।
যৌক্তিক চিন্তা করতে শেখায়
বিতর্ক মানেইতো যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির খেল। বিতর্কে নিজের পক্ষের বিষয়কে যৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য অনেক শক্ত যুক্তি সামনে নিয়ে আসতে হয়। এজন্য তাকে চিন্তাও করতে হয় পরিষ্কার ভাবে। ও একই সাথে নিজের যুক্তিকে সহজভাবে বোঝাতে হয় অন্যকে। সেজন্য সঠিক যুক্তি যেমন বাছাই করা লাগে একই সাথে তা সহজেই সবার বোধগম্য করার জন্যও মাথা খাটাতে হয়। ফলে তার মাঝে ক্রিয়েটিভ থিংকিং অ্যাভিলিটি বেড়ে যায় অনেক গুণ। এই ক্রিয়েটিভ থিংকিং অ্যাবিলিটি তার জীবনের ছোট বড় প্রায় সব ক্ষেত্রেই সঠিক যুক্তি কাজে লাগিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তাকে সাহায্য করে।
সহযোগিতা ও দলগত কাজের মানসিকতা
বলা হয়ে থাকে ২০ জন সৃজনশীল মানুষ একটা দল হয়ে কাজ করলে পৃথিবীকে বদলে দেয়া যায়! আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে দলগত কাজ আমাদেরকে অনেক বেশি এগিয়ে রাখে। আর বর্তমান সময়ে ছোট বড় সকল ক্ষেত্রেই দলগত হয়ে কাজ করার দক্ষতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। দলগত কাজের অন্যতম উদাহরণ হতে পারে বিতর্ক প্রতিযোগিতা। বিতর্কের মাধ্যমে কয়েকজন মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময় একসাথে কাজ করে, আলোচনা করে, পরিকল্পনা করে। আপনার সন্তানের মাঝে যদি ছোট থেকেই দলগত ভাবে কাজ করার মানসিকতা গড়ে উঠে তাহলে ধরে রাখুন সে দারুন কিছু করার জন্য প্রস্তুত।
উপস্থিত চিন্তায় পারদর্শী হয়
বিতর্কের জন্য যেমন আগে থেকেই একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিস্তর গবেষণা ও নিজের চিন্তা কাজে লাগিয়ে নিজের বক্তব্য প্রস্তুত করতে হয়, তেমনি বিতর্ক চলার মাঝেও নিজের উপস্থিত চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে বিপক্ষ দলের যুক্তির মোকাবিলা করতে হয়। কখনো কখনো বিপক্ষে দলের কোন যুক্তিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য ও বিপক্ষ দলের কোন যুক্তিকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য উপস্থিত চিন্তাকে কাজে লাগাতে হয়। এর ফলে বিতর্কের মাধ্যমেই একজন মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ও সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার যোগ্যতা অর্জন করে।
একজন মানুষ তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতাগুলো বিতর্ক প্রতিযোগিতা’য় নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই অর্জন করে থাকে। সেজন্য স্কুল পর্যায় থেকেই আপনার সন্তানকে বিতর্ক প্রতিযোগিতা’র সাথে যুক্ত থাকার জন্য উৎসাহিত করুন।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,780 total views, 2 views today