স্কুল জীবনের গণিতের বা বিজ্ঞান বিষয়ের সমীকরণগুলোর কথা মনে আছে? যেগুলো সমাধান করতে গিয়ে মাঝপথে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলতেন? কিংবা শ্রেণি শিক্ষকের ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’ বাক্যটার কথা মনে আছে? একটা নির্দিষ্ট পড়া বা অনুশীলন অনেক চেষ্টার পরও আপনার সন্তানকে শেখাতে পারছেন না? আপনার সন্তানের হোম টিউটর কখনো বলেছে ‘আপনার সন্তান বেশ মেধাবী, শুধু পড়ায় ফোকাস বা মনোযোগ একটু কম’
হ্যাঁ, ফোকাস! এই ফোকাস বা মনোযোগকে আপনি কালপ্রিট ধরতে পারেন কিংবা সফলতার হাতিয়ার হিসেবেও ধরতে পারেন। সঠিক ফোকাসের অভাবেই গণিতের বা বিজ্ঞানের সমীকরণটি মাঝপথে আটকে যেতো, ক্লাসে শতভাগ ফোকাস নিশ্চিত করতেই স্যার বলতেন ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’
কারণ এই ফোকাস বা মনোসংযোগের একটা কারিশমাটিক আউটপুট আছে! কোন কাজ করার সময় আপনার ফোকাস যদি অনেক বেশি সন্নিবেশিত বা নিরবচ্ছিন্ন হয় তাহলে আপনি ৫ ঘন্টার একটা কাজ দুই ঘন্টায় শেষ করতে পারবেন।
ফোকাস কেন গুরুত্বপূর্ণ?
কিছু শিশু কোন কিছু খুব দ্রুত শেখে। আবার অনেক শিশু শিখতে অনেক সময় নেয়! এই পুরো বিষয়টির মূলে রয়েছে ফোকাস। শুধু দ্রুত শেখা আর দেরিতে শেখা নয়, কোন কিছুতে পরিপূর্ণ ফোকাস না দিলে শেখাটা কখনোই পরিপূর্ণ হয় না। একটা সময় পরে দেখা যায় অনেক সময় নিয়ে কিন্তু ছাড়াছাড়া ফোকাসে যেটা শিখেছে সেটা ভুলেও গেছে দ্রুত।
আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করা লিসা সিমস এর মতে, ফোকাসের সাথে শিশুর আর্লি ডেভেলপমেন্ট অনেকাংশে জড়িত। সাধারণত শিশুদের মন বেশ বিক্ষিপ্ত থাকে। নতুন কিছু পেলেই শিশুরা তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। ফলে অনেক কিছুই পরিপূর্ণভাবে জানা ও শেখা হয় না। এই ফোকাসহীনতার ছাপ তার বাকি জীবনেও থেকে যায়। একাডেমিক পড়ালেখা থেকে শুরু করে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি; কোন কিছুতেই এই ধরণের শিশুরা সফল হতে পারে না।
কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তানের ফোকাস বিক্ষিপ্ত কি না?
বোস্টন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গত বছর একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়! গবেষণার অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের ১৫ মিনিট ধরে স্মার্টফোন সামনে নিয়ে বসে থাকতে বলা হয়। শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, তারা কোনভাবেই এই ১৫ মিনিট নিজেদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারবে না।
তারা কেউ যদিও এই ১৫ মিনিট নিজেদের স্মার্টফোন ব্যবহার করেনি। কিন্তু ১৫ মিনিট ধরেই তাদের মাঝে ভয়ানক কোন এক নেশাদ্রব্যের অভাব বোধ করার মতো অস্থিরতা দেখা গেছে।
মূলত আপনার সন্তানের মাঝে বিক্ষিপ্ততা ও ফোকাসহীনতা আপনি নিজে একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবেন।
আপনার সন্তানের হুট করে মনে হলো ভিডিও গেম খেলবে, কিন্তু পরক্ষণেই হুট করেই সে ভিডিও গেম অসম্পন্ন রেখে টিভি দেখতে গেলো! টিভি দেখতে গিয়েও স্থিরতা নেই তার মাঝে। বেশ কয়েকবার এলোমেলোভাবে চ্যানেল পরিবর্তন করে, টিভি দেখা রেখে হুট করেই তার ভাই-বোনের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে!
সহজ কথায় কোন একটি নির্দিষ্ট কাজে আপনি তাকে আটকে রাখতে পারবেন না। আপনি যখন তাকে খাওয়াবেন, কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করবেন, তার হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করতে বসাবেন তখনও সে স্থির থাকতে পারবে না। এমনকি আপনি যখন তাকে আর প্রিয় কোন কিছু করতে দিবেন তখনও না!
ফোকাস কেন বিক্ষিপ্ত হয়?
শিশুদের নতুনের প্রতি বাড়তি কৌতূহল
শিশুরা সাধারণত নতুনের প্রতি অনেক বেশি কৌতূহলী হয়। বর্তমান সময়ের শিশুদের চারপাশে এত বেশি ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট থাকে যে, একটা নির্দিষ্ট স্থানে ফোকাস ধরে রাখা বেশ কঠিনই বটে। কারণ তাদের মস্তিষ্ক সবসময় পরিবর্তন ও নতুন কিছু খোঁজে।
বয়সের তুলনায় কঠিন কোন কাজের ক্ষেত্রে
কখনো কখনো কঠিন কোন কাজ করতে গেলে (সেটা হতে পারে কঠিন কোন হোমওয়ার্ক) ফোকাসের অভাব দেখা যায়। সেক্ষেত্রে শিশুদের পড়ালেখা থেকে শুরু করে যেকোন কাজের দিকে খেয়াল রাখা উচিত। বয়স অনুপাতে সেটা যেন শিশুর জন্য চাপ না হয়ে যায়!
ঘুম ও খাবার দাবার
শিশুদের ফোকাসের বিক্ষিপ্ততার জন্য অপর্যাপ্ত ঘুম ও খাবার-দাবারকেও দায়ী করেন গবেষকরা। ফোকাস ধরে রাখার জন্য ঘুম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ক্ষেত্রে ৮-১২ ঘন্টার কম ঘুম হলেই তাদের মাঝে ফোকাসহীনতা দেখা দিবে। ফোকাস বাড়ানোর জন্য সাধারণত জাংক ফুড এড়িয়ে চলতে বলেন গবেষকরা।
আপনার ফোকাসহীনতা
শিশুর ফোকাসহীনতা দেখা দিতে পারে আপনার অমনযোগীতার কারণেও। সেটা কেমন? সহজ চোখেই কিন্তু এটা বোঝা যায়। অফিস কিংবা অন্য যেকোন কোথাও আপনার ঊর্ধ্বতনরা আপনার দিকে ফোকাস না দিলে আপনার ফোকাসও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকবে। আর শিশুর মন তো সবসময়ই উড়তে থাকে। সেখানে আপনার ফোকাসহীনতা তাদেরকেও ফোকাসহীনতার দিকে আরো বেশি করে ঠেলে দিবে।
ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটই কি ফোকাস হারানোর বড় কারণ?
এই আধুনিকতার যুগে এসে অনেকে এমন মনে করে থাকেন। মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। চারপাশে এত এত বৈচিত্রময় সব বস্তু, এত খেলনা, এত এত ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট; ফোকাস বিক্ষিপ্ত হওয়ারই কথা। গবেষকরাও প্রযুক্তির আধুনিকতাকে কিছুটা দোষ দিচ্ছেন! কিছুটা! হ্যাঁ, কিছুটাই!
গবেষণা কী বলছে?
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুয়েটস ইন্সটিউট অব টেকনোলজির প্রকাশনা সংস্থা এমআইটি প্রেস ‘দ্য ডিসট্রাকটেড মাইন্ড; অ্যানসিয়েন্ট ব্রেইনস ইন আ হাই-টেক ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি দারুণ গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেন। বইটি লিখেছেন, বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যাডাম গাজালি ও মনোবিজ্ঞানী ল্যারি ডি রোজেন। ব্যাপক সাড়া জাগানো এই বইতে বলা হয়েছে, সব দোষ হাই-টেক ওয়ার্ল্ডের না, মূলত অনেকাংশেই দোষটা আমাদের মস্তিষ্কের। আমাদের মস্তিষ্কই আমাদেরকে বার বার বৈচিত্রতার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এবং আমরা চাইলেই আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারি।
একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, ফোকাস নষ্ট করার মতো উপাদান মানুষের জীবনে সবসময়ই ছিলো। এই প্রযুক্তির যুগে উপাদানগুলো একটু বেড়েছে কেবল। এই বাড়তি উপাদানগুলো নিয়ে একটু বাড়তি সচেতনতাই কিন্তু আমাদের ফোকাসহীনতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে!
শিশুদের ফোকাস বাড়ানোর জন্য কী করবেন?
শারীরিক স্থিতিশীলতা
কোন কিছুতে ফোকাস বাড়ানোর অন্যতম পূর্বশর্ত হলো শারীরিক স্থিতিশীলতা। সঠিক পরিমানে ঘুম ও সঠিক খাবার সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।
ফোকাসের স্থিতিশীলতা
এরপর আপনি নজর দিতে পারেন টাইমিং-এর উপর। যখন যে কাজ করবে তাই যেন সে মনোযোগ দিয়ে করে। পড়ালেখার সময় যেমন পড়ালেখাতেই তার সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকবে, তেমনি খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া কিংবা টিভি দেখার ক্ষেত্রেও ফোকাস যেন একটি নির্দিষ্ট কাজের মধ্যেই থাকে।
কিন্তু বললেই তো আর হয়ে যায় না!
কিছু কাজ আছে আপনারও
সন্তানকে ফোকাস সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার জন্য আপনারও বেশ কিছু কাজ আছে। তার মধ্যে অন্যতম কাজ হলো প্রশ্ন করা। ধরুন, সে একটি গল্পের বই পড়লো। পড়ার পর তাকে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, এই গল্পে কোন চরিত্রটি তার ভালো লেগেছে? কোন চরিত্রটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে? টিভিতে সে যে অনুষ্ঠানটি দেখলো মাত্র সে অনুষ্ঠানের একটি শর্ট ব্রিফিং জেনে নিন না! তবে এই ধরণের প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিশুর বয়স বিবেচনায় রাখুন।
ফোকাস বাড়ানোর দারুণ কিছু এক্টিভিটি
প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস
পৃথিবীতে যে কোন কিছুতে সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো প্র্যাকটিস! আপনি যে কাজ যত বেশি প্র্যাকটিস করবেন সে কাজে আপনার দক্ষতাও ততটাই বেড়ে যাবে। একই কথা প্রযোজ্য ফোকাস ধরে রেখার ক্ষেত্রেও। এখন প্রশ্ন হলো, ফোকাস ধরে রাখার প্র্যাকটিসেই যদি ফোকাস ধরে রাখতে না পারে তাহলে ফোকাস বাড়বে কীভাবে?
ফোকাস বাড়ানোর টুলস
আপনাকে এই জটিলতার সমাধান দিবে দারুণ কিছু এক্টিভিটি ও টুলস। এই এক্টিভিটি ও টুলসগুলোকে আপনার সন্তানের ফোকাস অটো জেনারেট করার মতো করে তার দিকে নিয়ে নিবে। এই এক্টিভিটিগুলো দারুণ মজারও। ফলে বেশ কিছুদিন এইসব অ্যাক্টিভিটি ও টুলস দিয়ে প্র্যাকটিস করার ফলে আপনার সন্তানের ফোকাস আপনাআপনিই বাড়তে থাকবে।
শব্দজট বা ওয়ার্ড পাজল
এইসব এক্টিভিটি ও টুলস-এর মধ্যে শব্দজট বা ওয়ার্ড পাজল অনেক জনপ্রিয়। বিভিন্ন ক্লু-এর সাহায্যে একটা অর্থবোধক শব্দ তৈরি করতে হয়। ফলে দরকার পড়ে পূর্ণ ফোকাসের। দেশের বিভিন্ন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনগুলোতে এইধরনের শব্দজট দেখা যায়। কিন্তু এই ধরণের শব্দজট সাধারণত ছোটদের উপযোগী না। শব্দভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ না হলে সাধারণত এই ধরণের শব্দ মেলানো যায় না।
রুবিক্স কিউব, বোর্ড পাজল, লেগো
তবে বোর্ড পাজল, রুবিক্স কিউব, লেগো ইত্যাদি খেলানাগুলো একদম শিশুদের উপযোগী করেই তৈরি করা। এই ধরণের খেলনাগুলোও শিশুদের ফোকাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আপনি আপনার সন্তানকে এই ধরণের খেলনাও দিতে পারেন।
ফোকাস বাড়াবে ফোকাস চ্যালেঞ্জ
শিশুদের ফোকাস ধরে রাখা ও বৃদ্ধি করার জন্য একটি খেলনার কথা আপনার অবশ্যই জানা উচিত। অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্সের সাথে পরিচয় থাকলে আপনি ইতোমধ্যে এই অসাধারণ খেলনাটির কথা জানেন।
অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধি ও নিরবচ্ছিন্ন ফোকাস বাড়াতে ‘ফোকাস চ্যালেঞ্জ‘ নামে দারুণ একটি স্মার্টকিট এনেছে বাজারে।
‘ফোকাস চ্যালেঞ্জ’ কিটটিতে একটি সার্কিট বোর্ডের উপর আঁকাবাঁকা ৩টি ধাতব তার জুড়ে দেয়া আছে। সাথে আছে ২ টি ছোট-বড় লুপ। ফোকাস চ্যালেঞ্জের চ্যালেঞ্জটি হলো, তারটিকে লুপের ভেতর দিয়ে এমনভাবে নিয়ে যেতে হবে যেন লুপ ও তারের মধ্যে কোন ধরণের স্পর্শ না হয়। স্পর্শ লাগলেই চ্যালেঞ্জে হেরে যেতে হবে, শুরু করতে হবে আবার প্রথম থেকে। হ্যাঁ, আর এই খেলার মাধ্যমেই আপনার সন্তানের মাঝে গড়ে উঠবে মনোসংযোগ, ধৈর্য ও অধ্যবসায়।
আপনার সন্তানের যদি ফোকাস নাই থাকে তাহলে সে ফোকাস চ্যালেঞ্জ খেলায় মনোযোগ কেন দিবে?
এই জায়গাতেই ফোকাস চ্যালেঞ্জ অন্যান্য খেলনা থেকে আলাদা। বলা রাখা ভালো, এটা একটা খেলনা, যে খেলা খেলতে হয় শতভাগ ফোকাস নিয়ে। খেলনার আদলে তৈরি করাতে অন্যান্য বিজ্ঞানবাক্সের মতো এটিও একাডেমিক পড়ালেখা বা এক্টিভিটির মতো বিরক্তিকর না! ফোকাস চ্যালেঞ্জ দিয়ে খেলার মাধ্যমে ছেলে-বুড়ো সবাই দারুণ আনন্দ পায়। আর এই আনন্দের মাঝেই বাড়তে থাকবে ফোকাস কিংবা মনোসংযোগ।
ফোকাস চ্যালেঞ্জের ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন এখানে। অথবা ভিজিট করুন https://bit.ly/2AL0fvb
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
4,582 total views, 3 views today