আমরা যারা এখন বড় হয়েছি, ছোট বেলায় স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছেন ‘গাছেরও প্রাণ আছে’। গাছের আবার কিসের প্রাণ এবং সেটা আবিষ্কার কি জিনিস তা ওই বয়সে মাথায় ঢোকে নি। আবার অন্যদিকে ছোট বেলায় গাছপালা দেখলেই পাতা ছেঁড়া, ডালপালা ভাঙ্গা ফুল ছেঁড়া প্রায় আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বিজ্ঞান বই থেকে জানতে পারলাম আমাদের যেমন হাত কাটলে আমরা ব্যথা পাই তেমনি গাছও ব্যাথা পায়। পরে লজ্জাবতী গাছে স্পর্শ করলেই মনে হত যে উনি ঠিকই বলেছেন, “গাছেরও প্রাণ আছে”। কিন্তু তখনো জানতাম না যে এই বিজ্ঞানী শুধু উদ্ভিদবিজ্ঞান নয়, একই সাথে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানেও সমান মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, হ্যাঁ, তিনিই বিশ্ববাসীকে প্রথমবারের মত জানিয়েছিলেন গাছের আছে প্রাণশক্তি। আমরা যারা বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে জানি না চলুন তার সম্পর্কিত কিছু তথ্য জেনে আসি-
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
জগদীশ চন্দ্র বসু তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন আমলে বাংলা প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশ) মুন্সীগঞ্জে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ভগবান চন্দ্র বসু চাকরি করতেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের এবং একই সাথে ছিলেন ফরিদপুর, বর্ধমানসহ কয়েকটি এলাকার সহকারী কমিশনার হিসেবে। ব্রিটিশ আমলে জন্ম নিয়েও জগদীশ চন্দ্রের শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্বদেশী ভাষায়, অর্থাৎ বাংলা ভাষায়। সেই সময়ে অভিভাবকেরা নিজের সন্তানকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ছিলেন সবসময় তৎপর। পিতা ভগবান চন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষাগ্রহণের জন্য সর্বপ্রথম চাই নিজের মাতৃভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করা এবং দেশপ্রেমকে অন্তরে ধারণ করা। তাই তিনি জগদীশ চন্দ্র বসুকে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি করান। পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে জগদীশ চন্দ্র কলকাতা হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন এবং এরপর ভর্তি হন সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। ১৮৭৫ সালে তৎকালীন প্রবেশিকা (যা বর্তমানে মাধ্যমিকের সমমান) পাশ করে ভর্তি হলেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং এরপর সুযোগ পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজের খ্রিষ্টান যাজক বা ফাদার ইউজিন ল্যাফোন্টের নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি এবং তাঁর প্রকৃতির প্রতি অনুসন্ধান করার মানসিকতা তৈরী হয় ফাদারের প্রভাবেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে বোস চেয়েছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে। কিন্তু বাঁধ সাধলেন তার বাবা। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে এমন কিছু করুক যেন কারো অধীনে না থেকে স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করতে পারে। সেই সুবাদে বোস চলে গেলেন ইংল্যান্ডে এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হলেন। কিন্তু বেশিদিন পড়তে পারলেন না। মেডিসিন পড়াকালীন অবস্থায় প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। অচিরেই চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ ছেড়ে দিয়ে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। এর পরপরই বা প্রায় একই সাথে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন।
আরো পড়তে পারেন- মজার বিজ্ঞান- ছবি ও গল্পে প্রজাপতির জীবন চক্র
কর্মজীবন
জগদীশ চন্দ্র বসু বিদেশে অধ্যয়ন শেষে দেশে ফিরে আসেন ১৮৮৫ সালে। এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অস্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। তার গবেষণার সূত্রপাতও এখান থেকেই। তার মহান বৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহের সূতিকাগার হিসেবে এই কলেজকে আখ্যায়িত করা যায়। আমরা যে জগদীশ চন্দ্রের সাথে পরিচিত তার জন্ম এখান থেকেই। সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে অনেক কিছুর স্বল্পতা ছিলো। সেখানে ছিলো না কোনো ভালো মানের ল্যাবরেটরি, না ছিলো মৌলিক গবেষণা করার সুযোগ। কিন্তু বোস কলেজের সহায়তার আশায় বসে থাকেন নি। তিনি নিজেই গবেষণার জন্য নিজের টাকায় ফান্ড তৈরী করতেন।
গবেষণা কর্ম ও বিজ্ঞানে অবদান :-
অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি ও প্রেরণ
জগদীশ চন্দ্র বসু অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে দীর্ঘ আঠারো মাস গবেষণা করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী হের্ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।
রেডিও উন্নয়নে অবদান
বোসের কাজ ছিলো মূলত রেডিও মাইক্রোওয়েব অপটিক্স এর তাত্ত্বিক দিক নিয়ে। অর্থাৎ তিনি তাঁর গবেষণায় এই তরঙ্গের প্রকৃতি ও প্রণালী ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর গবেষণার দ্বারা যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বেতার যন্ত্রের উন্নয়নের দিকে কোনো ইচ্ছা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি যখন একদিকে বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে তখন মার্কনিও গবেষণা করে যাচ্ছেন একই বিষয়ে। শুধু পার্থক্য হচ্ছে বোস করছেন তাত্ত্বিক গবেষণা, তিনি যন্ত্রের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত না। কিন্তু মার্কনি বেতার যন্ত্র উন্নত করে রীতিমত হুলস্থূল করে ফেলছেন এবং বেতার টেলিগ্রাফের উন্নয়নে অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছেন। সমসাময়িক সময়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। যেমন রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার স্টেপানোভিচ পপোভ রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে বজ্রপাত ডিটেক্টর (lightning detector) তৈরীর চেষ্টা করছিলেন। বোসের রেডিও যন্ত্র উন্নয়নের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিলো না। এমনকি তিনি নিজের গবেষণাপত্র অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সুবিধার্থে উন্মুক্ত করে দিতেন। পেটেন্ট এর প্রতি ছিলো তাঁর তীব্র বিরাগ। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তাঁর আবিষ্কৃত গ্যালেনা ক্রিস্টাল ডিটেক্টরের কার্যপ্রণালী নিজের লেকচারেই বিবৃত করেন। তাঁর একজন আমেরিকান বন্ধু এই যন্ত্রটির জন্য তাকে পেটেন্ট নিতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি সেটা করেন নি।
রেডিও গবেষণায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে তিনিই সর্বপ্রথম রেডিও তরঙ্গ শনাক্ত করতে সেমিকন্ডাক্টর জাংশন ব্যবহার করেন। এখনকার সময়ে ব্যবহৃত অনেক মাইক্রোওয়েভ যন্ত্রাংশের আবিষ্কর্তাও তিনি। তাঁর গবেষণা থেকেই ১৯৫৪ সালে পিয়ার্সন ও ব্রাটেইন রেডিও তরঙ্গ শনাক্তকরণের জন্য সেমিকন্ডাক্টর ক্রিস্টাল ব্যবহার করেন।
আরও পড়তে পারেন- ডাইনোসর বিষয়ক কিছু ভ্রান্ত ধারণা এবং প্রকৃত সত্য
উদ্ভিদ শারীরতত্ত্বঃ স্পন্দন তত্ত্বের প্রবর্তন
১৯০১ সালে বোস বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন অবস্থায় এবং বিভিন্ন সময়ে কোষ মেমব্রেন বিভবের পর্যবেক্ষণ করে অনুমিত করেন যে উদ্ভিদও প্রাণীর মতো বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে সাড়া দিতে সক্ষম, অর্থাৎ তাদের ভেতর কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তারা ব্যথা অনুভব করতে সক্ষম, আনন্দ অনুভব করতে সক্ষম, এমনকি স্নেহ অনুভব করতেও সক্ষম। তিনি আরো প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদের একটি সঠিক জীবন চক্র এবং প্রজনন তন্ত্র রয়েছে যা প্রাণীর অনুরূপ। তাঁর এই গবেষণাপত্র তখন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে স্থান করে নিয়েছিলো।
উদ্ভিদও যে তাপ, শীত, আলো, শব্দ ও অন্যান্য অনেক বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করতে পারে সেই কথা বোস প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। আর এই প্রমাণের জন্য নিজেই তৈরী করেছিলেন ক্রিস্কোগ্রাফ (Crescograph) নামক বিশেষ যন্ত্রের। এই যন্ত্রের বিশেষত্ব হলো বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে উদ্ভিদে উৎপন্ন উদ্দীপনাকে এটি রেকর্ড করতে সক্ষম। এটি উদ্ভিদ কোষকে এদের সাধারণ আকার থেকে প্রায় ১০,০০০ গুণ বিবর্ধিত করে দেখাতে সক্ষম ছিলো যার দ্বারা সহজেই উদ্ভিদ কোষের উপর বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে সৃষ্ট স্পন্দন বা গতিকে প্রত্যক্ষ করা যেত। এর দ্বারাই তিনি দেখেন যে উদ্ভিদ কোষ ও প্রাণী কোষের মধ্যে বেশ কয়েকটি সাদৃশ্য আছে।
আরও পড়তে পারেন- মজার বিজ্ঞান- পানিচক্র
এই পরীক্ষা সবার কাছে প্রশংসার সহিত গৃহীত হলো। যদিও কিছু উদ্ভিদ শারীরতাত্ত্বিক এতে সন্তুষ্ট হলেন না এবং তাঁকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনধিকার প্রবেশকারী হিসেবে মন্তব্য করলেন। তথাপি জগদীশ চন্দ্র হাল ছাড়লেন না। ক্রিস্কোগ্রাফের সাহায্যে তিনি এরপর আরো পরীক্ষা চালালেন। পর্যবেক্ষণ করলেন অন্যান্য বাহ্যিক উদ্দীপক যেমন সার, আলোকরশ্মি, বেতারতরঙ্গ, তড়িৎ, রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদির প্রতি উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া কিরূপ হতে পারে। আধুনিক যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনেক শারীরতাত্ত্বিক তার এই তত্ত্ব সমর্থন করেছিলেন। তিনিই বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষ সাদৃশ্যপূর্ণ।
সুখ্যাতি ও সম্মাননা
বহুবিদ্যাজ্ঞ এই বিজ্ঞানী একাধারে অবদান রেখেছেন পদার্থ বিজ্ঞান, জৈব পদার্থ বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সায়েন্স ফিকশন-এ। বিজ্ঞান গবেষণায় প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছিলেন যার জন্য তার সুখ্যাতি তখনই ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না তিনি তা প্রমাণ করেন। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেন: ‘জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত’।
এছাড়াও তিনি দেশ বিদেশে অনেক সম্মাননা অর্জন করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- নাইটহুড (১৯১৬), রয়েল সোসাইটির ফেলো (১৯২০), ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য (১৯২৮), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি (১৯২৭), লিগ অফ ন্যাশন্স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো যার বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
2,204 total views, 1 views today