ধরা যাক আপনাকে সাত টুকরো কাগজ দেয়া হলো। এরপর আপনাকে বলা হলো কাগজগুলির আকৃতি পরিবর্তন না করে সেগুলি দিয়ে নানারকম ডিজাইন তৈরি করতে। সেক্ষেত্রে আপনি কয়টি ডিজাইন করতে পারবেন? খরগোশ বানাতে পারবেন? জাহাজ বানাতে পারবেন? খুব কঠিন মনে হচ্ছে কাজটা, তাই না? কিন্তু যদি আপনাকে বলি যে এমন সাতটি ডিজাইন আছে, যেগুলি জোড়া লাগিয়ে ৫০০০ এর ওপর নকশা তৈরি সম্ভব, তাহলে আপনার বিশ্বাস হবে? এই অদ্ভুত মজার জিনিসটিই হলো ট্যানগ্রাম!
লেগো অথবা বিল্ডিং ব্লকের মত ট্যানগ্রামও একটি শিক্ষণীয় খেলনা। ট্যানগ্রামের সাহায্যে শিশুরা জ্যামিতিক আকৃতি সম্পর্কে ধারণা পায়, এবং তাদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে ওঠে। ট্যানগ্রাম শিশুদের গণিত বিষয়ক দক্ষতাও বাড়ায়।
ট্যানগ্রাম কী?
ট্যানগ্রাম আবিষ্কৃত হয় চীনে। এখন থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে। এটি এক ধরণের দ্বিমাত্রিক নকশার ধাঁধা। এখানে একটি বর্গক্ষেত্রকে সাতভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিটি জ্যামিতিক আকৃতিকে আলাদাভাবে বলে ট্যান। আর পুরো পাজলটিকে একসাথে বলে ট্যানগ্রাম।
ট্যানগ্রামের ৭টি টুকরো কী কী?
- দুইটি বড় সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ
- একটি মাঝারি সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ।
- দুইটি ছোট সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ।
- একটি ছোট বর্গক্ষেত্র
- একটি সামান্তরিক
ঠিকভাবে জোড়া লাগালে এই আকৃতিগুলি দিয়ে বড় বর্গক্ষেত্র, আয়ক্ষেত্র, ত্রিভূজ ইত্যাদি বানানো যায়। শুধু তাই না, এগুলি দিয়ে নানারকম মজার আকৃতিও বানানো যায়। যেমন, খরগোশ, উট, বিড়াল, জাহাজ, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি।
ট্যানগ্রাম দিয়ে নানাভাবে খেলা যায়। সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, ট্যানগুলি দিয়ে বাচ্চাদের ইচ্ছেমত নানারকম জ্যামিতিক আকৃতি তৈরি করতে দেয়া। তবে এটাকে ধাঁধা হিসেবে খেললেই বেশি মজা! এটা খেলতে হয় কী করে? প্রথমে একটা আকৃতি ট্যানগ্রাম দিয়ে বানিয়ে দেখাতে হবে, তারপর সেটা এলোমেলো করে দিয়ে বাচ্চাদের বলতে হবে ঠিক ঐ আকৃতিটাই বানিয়ে দেখাতে।
গুগল স্ক্লার ঝেন ইউয়ান এবং তার সহকর্মীদের গবেষণা অনুযায়ী ট্যানগ্রাম পাজল ব্যবহার করলে বাচ্চারা সৃজনশীল হয়ে ওঠে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বেড়ে যায়।
শিক্ষামূলক খেলনা হিসেবে ট্যানগ্রামের গুরুত্ব
যখন বাচ্চারা বিভিন্নরকম ট্যান নিয়ে খেলে, তা তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আকৃতিগুলিকে দেখতে সাহায্য করে। নানারকম ভাবনা আসতে পারে তাদের মাঝে। টুকরোগুলিকে একসাথে জোড়া লাগালে কী হবে? জোড়া লাগানোর পর ঘোরালে কেমন হবে? আরেকপাশ থেকে দেখলে কেমন লাগবে?
বিভিন্ন পরীক্ষণ থেকে জানা গেছে, এই ধরণের মানসিক চর্চা কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে, এবং স্থানিক দক্ষতা বাড়ায়।
গবেষণা থেকে আরো জানা গেছে মানসিক দক্ষতার বৃদ্ধির পাশাপাশি গাণিতিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ট্যানগ্রাম সাহায্য করতে পারে। গবেষক উই লি চেং এবং কেলি ম্যাক্স একবার ৬ থেকে ৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের ট্যানগ্রামের সাহায্যে কিছু exercise করতে দেন। ফলাফল যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ছিলো।
সেই প্র্যাকটিস সেশনের পরে একটি পাটিগণিত পরীক্ষা নেয়া হয় বাচ্চাদের। যারা নূণ্যতম ৪০ মিনিট ট্যানগ্রাম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলো তারা গণিত পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো করেছে। ওয়ার্ম আপ এক্সারসাইজ হিসেবে শব্দজটের মত খেলার পাশাপাশি ট্যানগ্রামও বেশ ভালো করতে পারে বলে তারা সিদ্ধান্তে আসেন।
এই ছোট্ট পরীক্ষা থেকে হয়তো বা সিদ্ধান্তে আসা যায় না, তবে শিক্ষামূলক খেলনা হিসেবে ট্যানগ্রামের ইতিবাচক অবদান সম্পর্কে অনেক শিক্ষকই তাদের গবেষণায় জানিয়েছেন।
এই শিক্ষকেরা তাদের গ্রন্থে ট্যানগ্রামের যেসব উপকারিতার কথা বলেন, সেগুলি হলো,
১। বিভিন্ন ধরণের আকৃতি বুঝতে সাহায্য করে।
২। জ্যামিতির প্রতি আকর্ষণ তৈরি করে।
৩। স্থানিক সম্পর্ক বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করে।
৪। বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি কীভাবে একটা থেকে আরেকটায় রূপান্তরিত করা যায় তা শেখায়।
৫। সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়।
এছাড়াও টম স্কোভো তার এক জরীপে দেখিয়েছিলেন ট্যানগ্রাম কীভাবে প্রাথামিক শ্রেণির শিশুদের নানারকম সূত্র শিখতে এবং হিসাব নিকাশ করতে সাহায্য করে। তবে তিনি এও বলেছেন যে একা একা খেলার চেয়ে দলবদ্ধভাবে খেললে ট্যানগ্রামের উপকারিতা বেশি পাওয়া যাবে।
ছোট্ট শিশুদের ক্ষেত্রে ট্যানগ্রামের আরো একটি উপকারিতা হলো, এটি তাদের জ্যামিতি বিষয়ক বোধ উন্নত করতে সাহায্য করে। যেমন, তারা যখন ট্যানগ্রাম দিয়ে খেলবে, তখন সরলরেখা, ত্রিভূজ, সামন্তরিক, বর্গক্ষেত্র, কোণ ইত্যাদি নানারকম জ্যামিতিক ধারণা সম্পর্কে জানতে পারবে।
এছাড়াও তাদের অনুমান ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, এবং সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে অবগত হবে।
ট্যানগ্রামের আরো একটি চমৎকার বিষয় হলো, এর মাধ্যমে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায়, এবং অনেক প্রশ্ন করা যায়। এটা কী? ওটা কী? এটা কীভাবে হলো? ওটা কীভাবে করবো? ত্রিভূজটা ঘোরালে কী হবে? সামান্তরিকটি ওল্টালে কী হবে? এমন নানারকম প্রশ্নে বাচ্চাদের মস্তিষ্কের চর্চা হবে।
আরো কিছু বিষয়
ট্যানগ্রামের সাহায্যে বাচ্চারা কীভাবে জ্যামিতিক আকৃতি ব্যবহারে পটু হয়ে উঠতে পারে তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
এখানে যে তিন রকম ত্রিভূজ আছে, বড়, মাঝারি এবং ছোট, তাদের আকৃতি কিন্তু একইরকম। সবগুলিই সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ। এখানে দুটি ৪৫ ডিগ্রি এবং একটি ৯০ ডিগ্রি কোণ আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এগুলিকে একসাথে করলে একটা বর্গক্ষেত্র বানানো যাবে। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।
সব ত্রিভূজ দিয়ে কিন্তু এরকম করা যায় না। বাচ্চাদের নানারকম ত্রিভূজ দিয়ে খেলতে দিলে তারা বিভিন্ন রকম ত্রিভূজ, যেমন সমবাহু, সমদ্বিবাহু, এবং বিষমবাহু ত্রিভূজের নানারকম চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারবে, এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
শুরু করা যাক, কীভাবে ট্যানগ্রাম তৈরি করা যায়
ট্যানগ্রাম তৈরি করতে হলে প্রথমে নিচের চিত্রের মত একটা নকশা বানাতে হবে।
এরপর তা কম্পিউটারে প্রিন্ট নিয়ে কাগজ দিয়ে কেটে সাতটি টুকরো করতে পারেন। এছাড়াও আরো টেকসই ট্যানগ্রাম কিনতে পারেন বিজ্ঞানবাক্সের ওয়েবসাইট থেকে। এখানে কাঠের তৈরি ট্যানগ্রাম ছাড়াও আছে প্র্যাকটিসে জন্যে বেশ অনেকগুলি ফোমের ট্যানগ্রাম। এছাড়াও আছে অনেকগুলি নমুনা চিত্র এবং সমাধান।
ভার্চুয়াল ট্যানগ্রাম
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন সত্যিকারের ট্যানগ্রাম আর কম্পিউটার গেমসের ট্যানগ্রামের উপকারিতা একইরকম হবে কি না। তবে The National Council of Teachers of Mathematics (NCTM) দুটোকেই সমান উপযোগী বলেন।
সবশেষে বলা যায়, সময় কাটানোর জন্যে ট্যানগ্রাম একটি চমৎকার উপায় হতে পারে। এর আরেকটি মজার বিষয় হলো, এটি বয়স নিরপেক্ষ। অর্থাৎ এটি যেমন বাচ্চারা ব্যবহার করতে পারে, তেমন আপনিও ব্যবহার করতে পারেন। যেকোন বয়সী মানুষের জন্যে সময় কাটাতে ট্যানগ্রাম একটি চমৎকার মাধ্যম হতে পারে।
আপনার সন্তানের জন্যে ট্যানগ্রাম অর্ডার করতে পারেন এই লিংক থেকে।
2,727 total views, 2 views today