প্রতিটি মানুষই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাপারে বিভিন্ন ধাপে ধাপে বিকশিত হয়। এই বৃদ্ধি কেবল শারীরিক গঠনেই সীমাবদ্ধ থাকেনা বরং প্রভাব ফেলে সামাজিক ও মানসিক বিকাশেও। অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের জীবনের সবরকম ডেভেলপমেন্ট পূর্ণতা লাভ করে ৩৪ বছর বয়সের মধ্যে, এবং তারা এই সময়টাকে মোট ৭টি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। তাই এই স্টেজগুলোকে তাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য সহ একটা পূর্ণাঙ্গ মডেল হিসেবে তুলে ধরা হলোঃ
নবজাতক (প্রথম ১ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- প্রত্যাশা।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- বাবা-মা অথবা প্রাথমিক অভিভাবক।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- খাওয়া, খেলাধূলা, ধীরে ধীরে যোগাযোগ ও বন্ধন তৈরি করা।
প্রাথমিক অবস্থায় একজন নবজাতক খাওয়া, যত্ন ও পরিচর্যার জন্য সম্পূর্ণভাবে তার অভিভাবকের উপর নির্ভর করে। এই অভিজ্ঞতাগুলো সূচনালগ্নে জীবনের আশা ও ভরসার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি তার চাহিদাগুলো প্রত্যাশামাফিক পূরণ হয়, তাহলে ধীরে ধীরে সেই অভিভাবকের সাথে একটা দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়ে যায়, এবং সে তার সমাজের সিস্টেমের উপর নির্ভর করতে শেখে। কিন্তু তার অধিকারের ক্ষেত্রে যদি অযত্ন বা অবহেলার শিকার হয়, তবে শুরুতেই এই ভীতি থেকে এক অবিশ্বাস ও হতাশার জন্ম হয়, যা বাকি জীবন সব ব্যাপারে খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলে।
শিশু (২ থেকে ৩ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- ইচ্ছে।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- অভিভাবক, ভাই-বোন, অন্যান্য আত্নীয়স্বজন।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- কিছু ধরতে শেখা, হাঁটাচলা, কথা বলা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নিজে নিজে খাওয়া ও কাপড় পরতে শেখা।
এ পর্যায়ে শিশুটি তার সমস্ত মনোযোগ প্রয়োগ করে উল্লেখিত কাজগুলো আয়ত্ত করার জন্য, যাতে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। যে এই বয়সেই তার প্রচেষ্টা আর স্বাধীনতায় উৎসাহ পায় সে নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রাখতে শুরু করে। কিন্তু যদি কিছু অত্যুৎসাহী বাবা-মায়েরা এমন মেসেজ দেয় যে কোনক্রমেই ভুল করা যাবেনা, তাহলে তা বরং বাচ্চার মনে লজ্জা ও হীনমন্যতার সৃষ্টি করে।
শৈশবের শুরুতে (৩ থেকে ৫ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- উদ্দেশ্য।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- পরিবার, আত্নীয়স্বজন, প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নিজে নিজে খাওয়া ও কাপড় পরা, ঘোরাফেরা, কোনকিছু ব্যবহার করতে শেখা, ছবি আঁকা ও অন্যান্য স্কিল, নিজের প্রতিভা ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
বাচ্চার ক্ষমতা ও স্কিল যত বিকশিত হয় ততই সে ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরশীল হতে থাকে। নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কগুলো বুঝতে শুরু করে। স্কুলের শুরুতে তার প্রথমবারের মত বাহ্যিক দুনিয়ার সাথে পরিচয়ের পাশাপাশি কী করা উচিত ও কী করা নিষেধ তার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে শেখে। যে বাচ্চার বাবা-মা এ সময়ে সাহস ও উৎসাহ দেয়, সে বাইরের জগতের সাথে মানিয়ে চলা ও নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে নেয়। কিন্তু যার ওপর কঠিনভাবে নিয়ম চাপিয়ে দেয়া হয় সে একরকম অপরাধবোধে ভোগে ও সংকীর্ণ হয়ে যায়।
শৈশবের শেষে (৬ থেকে ১২ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- প্রতিযোগীতা।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- পরিবার, আত্নীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অন্যান্য।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব, শিক্ষাগত কাজ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, আত্ম-মূল্যায়ন, গ্রুপওয়ার্ক।
শিক্ষাগত কার্যক্রমের সাথে সাথে বাচ্চার মনোযোগ বাসা থেকে স্কুলকেন্দ্রিক হয়ে যায়। নতুন নতুন দক্ষতা শেখে ও ভুলের সম্মুখীন হয়। বন্ধুত্বের বলয়ের সাথে তার সামাজিক পরিধিও বিস্তৃত হয়। এ পর্যায়ে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সে প্রতিযোগীতা ও চ্যালেঞ্জ অনুভব করে, যা তার ভেতরের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যদি সে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে সফল না হয়, তবে নিজেকে হীনম্মন্য ও ব্যর্থ ভাবা শুরু করে।
কৈশোরের শুরুতে (১৩ থেকে ১৮ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- মানুষের উপর বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভরশীলতা।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- পরিবার, আত্নীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্টাফ, অন্যান্য মেন্টর ও পছন্দের মানুষজন।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- শারীরিক ম্যাচুরিটি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সবক্ষেত্রে নিজের গ্রুপ মেন্টেন করা, যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান ও আগ্রহ, আত্ম-সমালোচনা, জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ক্যারিয়ার বিষয়ক চিন্তাভাবনা।
বাচ্চাটি ধীরে ধীরে শিশু থেকে কিশোরে পরিণত হয়, এবং তার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব তৈরি। বুঝতে পারে সে তার বাবা-মায়ের চেয়ে আলাদা একজন মানুষ। এবং “আমি কে? আমি কোথায় যাচ্ছি? সেখানে কীভাবে পৌঁছাবো?” এধরনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু করে। তারসাথে পরিবার ছেড়ে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আর সামষ্টিকভাবেই তারা নিজেদের স্বকীয়তা ও কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
কৈশোরের শেষে (১৮ থেকে ২৪ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- নিজের মূল্যবোধের উপর বিশ্বাস, ভরসা ও নির্ভরশীলতা।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- পরিবার, আত্নীয়স্বজন, স্কুল ও কলেজের বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, নির্দেশক, ম্যানেজার, অন্যান্য মেন্টর ও পছন্দের মানুষজন।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- অভিভাবকের বলয় থেকে মুক্তি, আত্মপরিচয় ও বিবেক-বুদ্ধি প্রতিষ্ঠা, গ্র্যাজুয়েট হওয়া, ক্যারিয়ার নির্বাচন, সম্পর্কে জড়ানো এবং হয়তো বিয়ে ও সন্তান গ্রহণ।
এ পর্যায়ে টিনএজ লাইফের শেষে সন্তান তার অভিভাবকের কর্তৃত্ব থেকে স্বাধীনতা চায়। কেউ কেউ ধীরে ধীরে তার বাবা-মায়েরই কার্বনকপি হয়ে ওঠে আবার কেউবা নিজ জীবনে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ও বিবেকবোধ প্রতিষ্ঠা করে। সে তার ম্যাচুরিটিকে মুল্যায়ন করে এবং ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কর্মজীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। তারুণ্যের শুরুতেই যারা নিজের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে তারা সেই দিকেই বাকিজীবন পরিচালিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্যেরা এই প্রশ্নের সমাধানেই হারিয়ে যায় এবং একটা অনিশ্চিত সময়ের জন্য বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
যৌবনের শুরুতে (২৪ থেকে ৩৪ বছর)
- প্রধান চালিকাশক্তি- ভালোবাসা।
- টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্ক- জীবনসঙ্গী, পরিবার, আত্নীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, ম্যানেজার।
- উল্লেখযোগ্য কাজ- দাম্পত্য সম্পর্কে জড়ানো, বিয়ে, সন্তান গ্রহণ, ক্যারিয়ার, লাইফস্টাইল, স্নাতকোত্তর পড়াশোনা ও অন্যান্য এ্যাক্টিভিটি।
সর্বশেষ এই স্টেজে এসে বেশীরভাগ তরুণ-তরুণীই বাকি জীবনে ‘স্থিতিশীল’ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। অপ্রয়োজনীয় সঙ্গ ছেড়ে অল্পকিছু মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি ও সেই গ্রুপেই যাবতীয় যোগাযোগ স্থাপন করে। বিক্ষিপ্ত জীবনযাপন থেকে সরে এসে শুধু কর্মস্থল ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু যদি এ পর্যায়ে এসেও কেউ তার জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে, তবে নিজের প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যেটা ধীরে ধীরে নির্লিপ্ততা ও একাকীত্ব্বের দিকে নিয়ে যায়…
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
885 total views, 1 views today