রাজ। দেশের স্বনামধন্য একটি স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। যার দিন শুরুই হয় ঘুম থেকে উঠে স্কুল যাওয়ার ব্যস্ততা নিয়ে। এরপর কোচিং করে দুপুরে বাসায় ফিরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রামের পর বাসায় টিচার আসে। বিকেলে কখনো ঘন্টা খানেক ছোট ভাইএর সাথে একটু ফুটবল ক্রিকেট না হয় বাসায় বসে রুবিক্স কিউব মিলায়। রাজের সবচেয়ে সেরা টাইমিং ১ মিনিট ৪১ সেকেন্ড। বাবা মা দুইজনই রাজের পড়াশোনা নিয়ে খুশি। মধ্যবিত্ত পরিবারে সব হাসি খুশির উৎস যেন সন্তানের পড়াশোনার সাফল্যকে কেন্দ্র করে।
স্কুলের দেয়া বাড়ির কাজ গুলো রাজ নিজেই করে। পড়াশোনায় তার মনোযোগ প্রশংসা করার মত। কারন এই বয়সে বাচ্চারা সাধারনত পড়াশোনাকে নিজ থেকে আপন করে নেয় না। সেখানে রাজ একটু অন্যরকম। রাজের সাথে কথা বলে জানা গেল তার পড়া ভালো লাগার কারন গুলো। রাজ কিছু মুখস্থ করে না। কিছু না বুঝলে বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে, শিক্ষক আছে, বন্ধুরা আছে। রাজ সবার সাথে তার পড়াশোনার বিষয়গুলো ভাগ করে নেয়।
আমাদের মস্তিস্কে যে কোষ থাকে তাকে নিউরন বলে। প্রায় এক হাজার কোটির মত নিউরন এখানে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই কিন্তু এই নিউরন বাড়তে থাকে না। একটি নিউরন অন্য একটি নিউরনের সাথে পেচিয়ে থাকে এবং একসন ও ডেনড্রাইভের মাধ্যমের একটির সাথে অন্যটির সংযোগ করে। এই সংযোগ যত বেশি হতে মানুষ ততবেশি নতুন কাজ করতে পারে। আর মস্তিস্ককে ব্যস্ত রাখার কাজ হচ্ছে কোন জিনিস নিয়ে ভাবা এবং মনের মধ্যে সেটার একটা ভিউজুয়াল রূপ দেয়া। এতে করে সে সম্পুর্ন নতুন একটা বিষয় মনে রমধ্যে এঁকে ফেলতে পারে। শিশুকে বুদ্ধিদীপ্ত করতে এই নিউরন গুলোর সংযোগ বা সিনাপসকে বাড়াতে হয়। শিশুরা যখন কোন কিছু কল্পনা করে তখনই এই সিনাপসগুলো বাড়তে থাকে। যেমন পাজল, সুডোকো মিলাতে গেলে বাচ্চাদের বেশ ভাবতে হয় এবং কল্পনা করতে হয় যে কোন ঘরে কোন সংখ্যাটা যাবে।
কোন কাজ করার আগে সেটা যদি কল্পনায় একটি ফ্রেমে নিতে পারে তাহলে কাজটা বাস্তবে রূপ দেয়া সহজ হয়ে যায়। একজন চিত্রশিল্পী যখন কোন ছবিকে রঙ তুলির আচড়ে ক্যানভাসে আঁকেন তার আগে কিন্তু ঐ ছবিটাকে তার কল্পনায় নিয়ে আসতে হয়। কল্পনার ভাষাকে সে ফুটিয়ে তুলতে থাকেন তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে। এভাবেই রূপ নেয় এক একটি কালজয়ী চিত্রকর্ম।
রাজের রুবিক্স কিউব মেলানোয় ফিরে আসি। সে যখন কিউবটিকে বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মিলাচ্ছে তখন বার বার সে চোখ বন্ধ করছে আর চোখ খুলে দেখছে ঠিক আছে কিনা। আশ্চর্যের বিষয় হলো শেষে ৩০ সেকেন্ড সে না দেখেই কিউবটা মিলিয়ে ফেলল। ব্যাপারটা এখানেই , রাজের মস্তিক কিউবকে ধারন করে ফেলেছে। প্রতিটা রঙ এবং তার অবস্থান সে কল্পনায় নিয়ে গেছে। রাজ ভালো ছবিও আঁকে। এই বয়সেই সে বেশ কিছু পুরষ্কারও জিতে ফেলেছে। ইদানিং সে একটা কাজ শুরু করছে , সেটা হলো তার ৪ বছর বয়সী ছোট ভাই রামীমকে সে কিউব মেলানো শিক্ষাচ্ছে আর রামীমও সেটা আয়ত্বে নিতে বেশি সময় নিবে না সেটা তার কিউবের মুভমেন্ট দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রাজ এই কাজটা করতে পেরে ভীষন খুশি।
রাজের মত হয়েই সব বাচ্চার জন্ম হয়, কিন্তু বাবা মায়ের অসচেতনার জন্যে সবাই রাজ হয়ে ওঠে না। ক্লাস থ্রিতে থাকতে শিক্ষকরা যেখানে বই দেখে “তোমার দৈনন্দিন জীবন” নিয়ে একটা অনুচ্ছেদ লিখতে বলে সেখানে রাজ তার মায়ের কাছে আবদার করে যে সে নিজে যেভাবে প্রতিদিন পার করে সেই কথা গুলোই সে লিখবে। মায়ের সম্মতিও মিলে যায় এবং অনুচ্ছেদে সে বেশ কিছু ভুলও করে ফেলে। শিক্ষক রাজের এমন ইচ্ছা দেখে খুব খুশি হয় এবং তার ভুলগুলোকে শুদ্ধরে দেন। এখন রাজের কোন অনুচ্ছেদ নিজ থেকে লিখতে তেমন কোন ভুলই হয় না। কারন সে বই থেকে মুখস্থ করা শিখে নি। নিজের মস্তিস্ক ব্যবহার করে শিখতে চেষ্টা করেছে আর তাকে সে তার মায়ের সহযোগীতা পেয়েছে।
ব্যবহারিক টুলস গুলোর সাথে শিশুকে পরিচয় করানোর মাধ্যমে তাকে নতুন নতুন বিষয় শিখতে উৎসাহিত করতে হবে। পড়াশোনা আনন্দদায়ক হলেই শিশু সেটা বার বার করতে উৎসাহিত হবে।
শিশুদের এমন উদ্দীপ্ত করতে বাবা মাকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। কারন শিশুকে এই সব বিষয় গুলোর সাথে পরিচিত করার কাজই করে থাকবে বাবা মা। একটা কমন বিষয় বলা যাক, শিশুকে আমরা অংক শিখাবো তাই তার সামনে বই খাতা দিয়ে ৩ সাথে ৫ যোগ করলে যে ৮ হয় সেটা ৩০ মিনিট ধরে হাত গুনে শিক্ষানোর কি মানে থাকে। সেও এটায় আনন্দ পায় না। হ্যা, অবশ্যই সে এটা নিজ থেকে মেনে নিতে পারে না। পড়াশোনায় আনন্দ থাকতে হয়। তাই তার সামনে প্রায়ই সাপ লুডু নিয়ে বসেন, খেলতে শেখান। সে খেলাটাকে আনদের সাথে গ্রহন করবে। সেখানে সে যোগ শিখে যাবে। এভাবে এক সপ্তাহ চালিয়ে গেলে দেখবেন যে পড়া তিন চার মাসে হত না সেটা এক সপ্তাহেই হয়ে যাবে। রাজ রামীমকে নিয়ে প্রায়ই তো বাবা মাসহ চার জনে খেলতে বসে যায়। মাসে অন্তত দুই দিন তারা ঘুরতে যায় এবং বাসায় ফিরে রাজ ঐদিন কি কি দেখল এবং জানল সেটার একটা লিস্ট বাবাকে দেখায়। শুরুর দিকেই কিন্তু রাজ এত কিছু পারত না। তার সাথে তার বাবা মা এইগুলোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একটি শিশুর ভবিষ্যৎ কে কেমন দেখতে চাই সেটার জন্যে তার বয়স পাঁচ পূর্ণ হওয়ার আগেই ভাবতে হয়। কারন নিউরনের সিনেপস গুলো আর পাঁচ বছর বয়সের পরে বাড়ে না।
সন্তানের সঠিকভাবে বেড়ে উঠা নির্ণয় করতে শুধু তার শারীরিক ওজন আর উচ্চতা বৃদ্ধিকেই বুঝায় না। তার মানুষ্যিক বিকাশকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
শিশু ঠিক ভাবে বেড়ে উঠছে কিনা সেটার পরীক্ষা করতে অভিভাবকেরা শুধু শারীরিক ওজন আর উচ্চতাকেই বিবেচনা করেন কিন্তু তার সন্তানের মেধার এবং মননশক্তির কতটুকু বৃদ্ধি হলো সেটার চিন্তা করে না। বড় হলে সব শিখবে এমন ধারনাই শিশুকে পিছিয়ে দেয়। তার ভাবনার আকাশে মেঘের ছায়া পড়ে যায় ততদিনে। সে নতুন নতুন বিষয়গুলো ভাবতে অভ্যস্ত হয় না। বাবা মায়েরা যদি সন্তানের সব কিছুই ধরে বেধে নিয়ম করে দেন তাহলে সে নিজের কাজ গুলো বা নিজে নতুন কিছু কিভাবে চিন্তা করবে! শিশুকে ভাবতে এবং নতুন জিনিসে সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের অবজারভেশনে রাখতে হয়। ভালো খারাপ দিক গুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে। বাবা মা হয়ে শিশুর জন্যে ভালো দিক গুলো চাপিয়ে দিলেই যে সব সময় ভালো হবে এমনটা কিন্তু না, তার সাথে খারাপ দিক গুলো ফলাফল নিয়েও আলোচনা হবে। কোন কিছু চাপিয়ে দিলে সেটা কেউ নিতে পারে না, শিশু বা বড় কেউই না।
চিলড্রেনস আর্ট এ্যাডুকেসন গ্রন্থে মেরিয়েন কোল বলেছেন- শিশুর সৃজনশীল কাজ শিশুকে সিদ্ধান্ত প্রহণে দক্ষ করে। কারণ সৃষ্টির বৈচিত্র্যতার জন্য কী করব কী করব না, তা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া প্রযুক্তি জ্ঞান ও নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্র তৈরি হয় শিশু সৃজনশীলতার মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় যে প্রাপ্তি ঘটে তা হলো শিক্ষা জীবনের সফল্য। কারণ শিশুটি বুঝতে পারে আনন্দের এই প্রাপ্তির প্রদর্শন, প্রয়োগ, অর্জন তার সব কিছু ঘিরে আছে তার স্কুল বা বিদ্যাপীঠ।
একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, সেটা হলো মেধা আর সৃজনশীলতা এক জিনিস না। মেধা যেখানে কোন কাজকে সুন্দর করে শেষ করে সেখানে সৃজনশীলতা মানেই হলো নতুন কোন কাজ করা। একটি জেনারেশন যদি সৃজনশীল না হতে পারে তাহলে উন্নয়নটা হবে কিভাবে। সমস্যা গুলোর সমাধান করবে কে! সমাধানের রাস্তাটা আসে ভবিষ্যৎ কে আমরা কতটুকু বুঝতে পারি সেটা থেকে। স্যারের এল এ অ্যালান একটি উক্তি আছে “পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎকে ধরার ফাঁদ” । তাই আগামীকাল কেমন হতে পারে সেটা আজ ভাবতে পারাটাই সৃজনশীলতা। এটা না থাকলে আমরা নতুন নতুন বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হতে পারব না। তাই দেশকে জাতিকে এগিয়ে নিতে চাইলে এমন শৃজনশীলতার চর্চার কোন বিকল্প নেই। আর এই চর্চাটা শুরুই হয় পরিবার থেকে। তাই বাবা মায়ের ভূমিকাই প্রধান।
আমরা বিশ্বাস করি আমাদের প্রতিটা শিশুই রাজের মত করে বেড়ে উঠবে। নতুন নতুন বিষয়গুলোর সাথে শিশুরা পরিচিত হবে। তারা ঘরে বসে রংধনু, পেরিস্কোপ বানানোর জন্যে ঘরেই একটা ছোট্ট ল্যাব তৈরি করবে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,959 total views, 1 views today