শিউলি পারভিন রান্না ঘরে কাজ করছিলেন, হঠাৎ অন্য রুম থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখেন তার দুই সন্তান আবারো মারামারি করেছে। কিন্তু মারামারির কারণটা খুবই ছোট, টিভির রিমোট নিয়ে। গত পরশুও নিজেদের খেলনা নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়েছে দুজনের মাঝে। শিউল পারভিনের সন্তানদের মাঝে এই দ্বন্দ্বটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। যাদের সমবয়সী দুজন সন্তান আছে তাদের কাছে শিউলি পারভিনের গল্পটা পরিচিত মনে হচ্ছে? জ্বী, গল্পটা আপনারই! সমবয়সী দুইটা সন্তান থাকলে তাদের মধ্যে সিবলিংস রাইভালরি বা ভাই-বোনের দ্বন্দ্ব প্রায় সব পরিবারেই দেখা যায়। এটা শিউলি পারভিন কিংবা আপনি, কারও জন্যই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় কিছু কৌশল অবলম্বন করে তাদের মাঝ থেকে সিবলিংস রাইভালরি দূর করা সম্ভব। চলুন জেনে নিই-
সন্তানদের মাঝে তুলনা করা যাবে না
দু-জন সন্তান থাকলে আমরা অনেক সময় তাদের সামনেই একজনের সাথে আরেকজনের তুলনা করি। তুলনা করার ফলে সন্তানেরা একজন আরেক জনের প্রতি হিংসা অনুভব করে। দু-জন সন্তানের আলাদা আলাদা বিশেষ গুণ থাকতে পারে। কেউ গণিতে অনেক ভালো, আবার কেউ বিজ্ঞান অনেক ভালো বোঝে। এসব ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় বাচ্চাদের মাঝে তুলনা করি। সন্তানদের মাঝে কখনো তুলনা করা যাবে না। বরং তাদের নিজেদের আলাদা আলাদা সক্ষমতার জন্য অনুপ্রাণিত ও প্রশংসিত করতে হবে।
সমস্যা সমাধানে দু-জনকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে
ভাই-বোনের মাঝে যদি কখনো কোন কারণে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সেটা বাবা-মাকে এমন ভাবে সমাধান করতে হবে, যেন সেখানে কোন পক্ষপাত মূলক আচরণ না দেখা যায়। সমাধানের ক্ষেত্রে কখনো একজনকে সঠিক ও অন্য জনকে ভুল প্রমাণ করা যাবে না। দুজনই যেন নিজেদেরকে জয়ী ভাবে এমন পন্থা বের করতে হবে। ধরুন, আপনার দুই সন্তান খেলতে গিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে একজনকে বলুন “তোমার কি মনে হয় না, সিফাতের একটা সুযোগ পাওয়া উচিত?” এতে তারা নিজেরাই নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে ও নিজেরা একসাথে শান্তভাবে খেলবে।
বিশেষ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে তাদের কথা শুনতে হবে
সিবলিংস রাইভালরি অনেক ক্ষেত্রে সন্তানদের মাঝে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াতে পারে। যদি এমনটা হয় তাহলে বাবা-মাকে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সন্তানরা যদি একজন অন্য জনকে আঘাত করে তাহলে দ্রুত তাদের আলাদা করতে হবে। এরপর আলাদাভাবে দু-জনের কথা শুনতে হবে। শুনে যার আক্রমণাত্মক আচরণ ধরা পড়বে তাকে বোঝাতে হবে, কেনো তার আচরণটা গ্রহণযোগ্য না। আর অন্য জনকে আলাদাভাবে সহমর্মিতা জানাতে হবে। এবং দু-জনকে পরবর্তীতে একসাথে খেলার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। একজন সন্তান যদি ঘন ঘন আক্রমণাত্মক আচরণ করতে থাকে তাহলে তার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরো পড়ুন-শিশুর ভাষাজ্ঞান উন্নতিতে বাবা-মায়ের ভূমিকা।
সন্তানদেরকে অনুভূতি প্রকাশে উৎসাহিত করতে হবে
বিভিন্ন কারণে সমবয়সী ভাই-বোন একজন অন্য জনের উপর হতাশ হতে পারে, একজনের প্রতি অন্য জনের অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু এইসব অভিযোগ-অনুযোগ যদি প্রকাশ না পায়, তাহলে বাবা-মা তা সমাধানও করতে পারবেন না। সন্তানদের সাথে এমন একটা সম্পর্ক কিংবা এমন একটা পারিবারিক আবহ তৈরী করতে হবে, যেন সন্তান তার সকল ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিযোগ ও ভাবনা নির্দ্বিধায় বাবা-মার কাছে প্রকাশ করতে পারে। প্রয়োজনে অভিযোগ-অনুযোগ শোনার জন্য একটা সাপ্তাহিক পারিবারিক বৈঠক করা যেতে পারে। এতে পরিবারের সবার প্রতি সবার দৃঢ়তাও বাড়বে।
সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ও অনুপ্রাণিত করতে হবে
সন্তানদের মাঝে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের অভ্যাস গড়ে তুললে সিবলিংস রাইভালরি থাকবে না। সহযোগিতাপূর্ণ আচরন গড়ে তোলার জন্য পরিবারিক বিভিন্ন কাজে সন্তানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে সন্তানদেরকে এমন কোন কাজ দিন যেখানে একই সাথে তাদের দু-জনের সমান সাহায্য লাগবে। যেমন, পারিবারিক পিকনিকে সন্তানদেরকে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব দিতে পারেন। সন্তানেরা একই সাথে কাজ করার ফলে তাদের মাঝে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সন্তানেরা একজন অন্য জনের সাথে কোন সহযোগিতাপুর্ন আচরণ করলে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করুন। এতে তারা উৎসাহিত হবে। যেমন সন্তানেরা একে অন্যকে সহযোগিতা করলে আপনি বলতে পারেন “ তুমি তোমার ভাইকে অনেক ভালোবাসো, এতে আমরা তোমাকে নিয়ে গর্বিত। তোমাদের কাছ থেকে আমরা এমন সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ আশা করি”। এতে সন্তানেরা সহযোগিতাপূর্ণ আচরণে আরো উৎসাহি হবে ও তাদের মাঝে সিবলিংস রাইভালরি থাকবে না।
দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে প্রথম সন্তানকে অবগত করতে হবে
প্রথম সন্তান যদি হঠাৎ এমন একজনকে আবিষ্কার করে, যে পরিবারের সবার আগ্রহের দখল নিয়ে নিচ্ছে, তাহলে সে দ্বিতীয় সন্তানের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতে পারে। সেজন্য দ্বিতীয় সন্তান আসার আগেই প্রথম সন্তানকে জানাতে হবে যে, তাদের পরিবারে আরেকজন আসছে তাকে সবাই মিলে সাহায্য করতে হবে। মায়ের গর্ভাবস্থা থেকেই প্রথম সন্তানকে এমন মেসেজ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন পরীক্ষানিরিক্ষা বা আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার সময় প্রথম সন্তানকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে সে তার অনাগত ভাই/বোনের প্রতি আগে থেকেই ভালোবাসা অনুভব করবে।
সিবলিংস রাইভালরি প্রায় সব পরিবারের কম-বেশি দেখা যায়। বাবা-মায়েরা এইসব কৌশল মেনে চললে খুব সহজেই সন্তানদের মাঝ থেকে সিবলিংস রাইভালরি দূর করা সম্ভব।
আরো পড়ুন-শিশুর শৈশব আনন্দময় করে তোলার পরামর্শ।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
তথ্যসূত্র-parenting
1,214 total views, 1 views today