ড. আজম আলী নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার ‘বেয়ার ইনোভেটর’ পেয়েছিলেন ২০১০ সালে। এছাড়া আরও অনেকগুলো গবেষণা ও উদ্ভাবনের আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব রয়েছে এই আজম আলী’র। আচ্ছা তোমরা ড. আজম আলীকে চেনো তো? না চেনারই কথা, আমরা ক’জনই বা বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের খোঁজ রাখি! আর চিনলেও হয়তো হাতে গোনা দু-একজন চিনি। চেনা অচেনার কথা বাদ দিয়ে চল আজ আমরা আজম আলী সম্পর্কে জেনে নেই।
জন্ম ও পরিবার
আজম আলী ১৯৬৭ সালে এপ্রিলে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের (বর্তমান নাম সেতাবগঞ্জ) বন্ধুগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আব্দুল জলিল চৌধুরী, মা শরিফা বেগম। বাব ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা ও মা গৃহিণী। আজম আলীরা ছিলেন ৭ ভাই বোন। বিবাহিত জীবনে দুই ছেলের জনক ড. আজম আলী ও নার্গিস দম্পতি। বর্তমানে তিনি সপরিবারে নিউজিল্যান্ড বসবাস করছেন।
শিক্ষাজীবন
ছোট বেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রেমে পড়ে যান আজম আলী। স্বপ্ন ছিল প্রকৃতির লতাপাতা বা এ রকম কোনো জৈব উপাদান থেকে কিছু একটা আবিষ্কার করা। বিজ্ঞানটা ভালোভাবে আয়ত্তে নিতে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু। সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে শেষ করেন মেধাবী আজম আলী। ১৯৮২ সালে সেতাবগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞানবিভাগে প্রথম শ্রেণীতে মাধ্যমিক স্তর শেষ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আবারও বিজ্ঞান বিভাগে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন রসায়নে। ১৯৮৮/৮৯ সালে স্নাতক শেষ করে ১৯৯১ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন প্রথম বিভাগে। ২০০০ সালে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়া থেকে পিএইচডি করেন পলিমার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ে।
আপনার সন্তানকে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করতে তাকে বিজ্ঞানবাক্স উপহার দিন।
কর্মজীবন ও গবেষণা
ড. আজম বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোর ডানেডিনে কর্মরত থাকলেও তিনি ২০০০ সালে পিএইসডি শেষ করার পর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগ দেন পোহাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। ঐ বছরের অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের জুলাই পর্যন্ত আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনায় রসায়ন বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে গবেষণা শুরু করেন। এখানে তিনি টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, পলিমার বা বায়োপলিমেরিক বায়োম্যাটারিয়ালসের উন্নয়ন, ন্যানোফটোরেজিস্ট সিনথেসিস, ফটোলিথোগ্রাফি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর তিনি নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান গবেষণামূলক সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রাউন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এজি রিসার্স) হিসাবে কাজ শুরু করেন। এজি রিসার্চ ছাড়ার আগে তিনি জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে বায়োম্যাটারিয়াল এবং ন্যানোটেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানী দলের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই নিউজল্যান্ডেই তিনি ভেড়ার লোমের প্রোটিন নিয়ে গবেষণা করেন এবং উদ্ভাবন করেন নতুন এক চিকিৎসা পদ্ধতি।
ড. আজম আলী অগ্নিদগ্ধ ও রাসায়নিক কারণে ক্ষতিগ্রস্থ রোগীর ত্বক ও মাংসপেশীর চিকিৎসায় ব্যবহার করেছেন উল (ভেড়ার লোম)। ভেড়ার লোমে এক ধরণের প্রোটিন থাকে। এর নাম কেরাটিন। এই কেরাটিনকে তিনি পোড়া ও ক্ষতের চিকিৎসায় ব্যবহার করেছেন। উল থেকে চিকিৎসা, শুনতে অবাক মনে হলেও তিনি তাই করেছেন। ড. আজম আলী বলেন-
“ আগুনে মানুষের শরীরের ত্বক ও মাংস উভয়ই ঝলসে যায়। বাজারে যে ওষুধগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো শুধু ক্ষত স্থানের ত্বকই তৈরি করে। আর আমি কাজ করেছি উল নিয়ে। উলে কেরাটিন নামের প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিনটা মানুষের নখ ও চুলেও পাওয়া যায়। আমি নিউজিল্যান্ডে পাঁচ বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করেছি। এই কেরাটিনকে রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করে কেরাজেল, কেরাডাম ও কেরাফোম তৈরি করেছি। ক্ষত স্থানে এগুলো ব্যবহার করলে শুধু ত্বকই নয়, মাংসপেশির টিস্যুও তৈরি করবে। তা ছাড়া তুলনামূলক ৪০ গুণ দ্রুত কাজ করবে”।
এই জৈব প্রোটিন ক্ষত স্থানের আরোগ্যের সাথে সাথে ক্ষত টিস্যু বা চামড়াকে দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। ড. আজম আলী উদ্ভাবিত এধরনের দুটি প্রযুক্তি ও ওষুধ ইতিমধ্যে নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের স্বীকৃতি পেয়েছে।
এছাড়া তিনি কাজ করেছেন মালয়েশিয়ার পাম অয়েল বোর্ড, জাপানের জায়েরি, দক্ষিণ কোরিয়ার পোসটেকে। ড. আজম আলী বিজ্ঞানী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনে। অস্ট্রেলিয়ান সোসাইটি ফর বায়োম্যাটারিয়ালস অ্যান্ড টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, নিউজিল্যান্ড কন্ট্রোলড রিলিজ সোসাইটি, ক্যান্টাবুরি মেডিক্যাল রিসার্চ সোসাইটি, অস্ট্রেলিয়ান পলিমার সোসাইটি, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর পেটেন্টগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আজম আলীর ১৮টি আন্তর্জাতিক পেটেন্ট রয়েছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
‘বেয়ার ইনোভেটর্স’ পুরস্কার ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ২০০৩ সালে পেয়েছেন এনসিবিসি (ইউএস) রিসার্চ ফেলোশিপ, ২০০১ সালে ডিওডি (ইউএস) রিসার্চ ফেলোশিপ, ২০০০ সালে অর্জন করেন ব্রেইন কোরিয়া কে-২০ ফেলোশিপ, ১৯৯৯ সালে পান মালয়েশিয়ান প্রাইমারি ইন্ডাস্ট্রি সিলভার মেডেল, ১৯৯৭ সালে অর্জন করেন মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বোর্ড কর্তৃক ফেলোশিপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ১৯৮৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর চ্যান্সেলর স্কলারশিপ পান তিনি।
বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে থাকলেও নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে দেশে ফিরে এসে দেশকে কিছু দিতে চান। অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্সের পক্ষ থেকে ড. আজম আলীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ্যির জন্য রইল শুভকামনা।
আরো পড়ুন- জগদীশ চন্দ্র বসু-একজন বিজ্ঞানী ও একজন বাংলাদেশী।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
তথ্যসূত্রঃ
প্রথম আলো
Daily Star
Wikipedia
1,118 total views, 3 views today