বাচ্চারা মাঝেমাঝে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোন আদেশের বিরোধীতা করে বা কথা শুনতে চায় না। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাবা-মাকে বাধ্য হয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। বাবা-মা অনেকসময় সংশয়ে ভোগেন তারা সন্তানের প্রতি কঠোর হবেন নাকি কোমল বা এই দুটোর সমন্বয়ে একটা মধ্যপন্থা নিবেন। কিন্তু যাই হোক, সবকিছুরই উদ্দেশ্য থাকে সন্তানের অসৌজন্যতা দূর করে তাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা। একটি ছোট্ট সহজ উদাহরণের মাধ্যমে আপনি নিজেই বুঝে নিতে পারেন আপনি অভিভাবক হিসেবে কেমন এবং তার প্রেক্ষিতে আপনার কী করা উচিত-

সিচুয়েশন: “ধরুন আপনার ১০ বছর বয়সী সন্তান টিভিতে একটা রিয়েলিটি শো দেখছে, যখন তার সারা সপ্তাহের ময়লা কাপড়গুলো ভিজিয়ে রাখা আছে এবং তার ধুয়ে ফেলার কথা ছিল”…

১. এক টাইপের অভিভাবকরা রুমে ঢুকেই চেঁচামেচি শুরু করবে, “তোমার এত বড় সাহস, এখন টিভি দেখতেসো, তোমাকে না কাপড় ধুইতে বলসি?”, তখন বাচ্চাটা যদি উত্তর দেয় “কিন্তু প্রোগ্রামটাতো মাত্র শুরু হইলো”, তাহলে সে বলবে “আমি এতকিছু জানিনা, এক্ষুনি টিভি অফ করে বাথরুমে যাও, না হলে আজ আর টিভির সামনেই বসতে দিবনা।”

এই ধরনের অভিভাবকরা মনে করে যে পরিবারে বাবা-মায়েরাই সবরকমের ডিসিশান নেবে পরিবারটাকে চালানোর জন্য। এরা বাচ্চাদের অযোগ্য এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মত ম্যাচিউরড হয়নি বলে মনে করে। তারা আশা করে বাচ্চারা বিনাবাক্যে তাদের সব আদেশ নিষেধ মেনে চলবে। অবশ্য এর ফলে তারা বাচ্চার জীবনের সকল দায়দায়িত্বও নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয়। তাদের বাচ্চা বড় হয়ে কী হবে সে সিদ্ধান্তও তাদের নেয়া থাকে এবং সেই পথে তাদের পরিচালিত করার চেষ্টা থাকে। তাদের আদেশ মানলে প্রশংসা অথবা পুরষ্কার এবং না মানলে শাস্তি এই সিস্টেমেই তারা তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। যদি ভুলেও বাচ্চারা কোন প্রশ্ন করে বসে তাহলে তারা বিরক্ত হয়ে বকা দেয় “তোমার এতবড় সাহস আমার সাথে বেয়াদবি করছো, আমি তোমার বাবা/মা!” তারা বাচ্চার কাছে কেবল আনুগত্য আর অন্ধবিশ্বাস চায়, কিন্তু এর বদলে তার মানসিক বিকাশের কোন প্রয়োজন বোধ করেনা। কিছু পরিবার এই সিস্টেমটাই ফলো করে। তাদের মতে, এর মাধ্যমেই সন্তান ভদ্রতার সাথে বেড়ে উঠবে এবং সমাজে “ভালো ছেলে/মেয়ে” হিসেবে পরিচিতি পাবে। এবং অনেকক্ষেত্রে এটা প্রথার মতই গড়ে ওঠে যে তাদের বাবা-মা তাদের আদেশ-নিষেধ দিয়েই বড় করেছেন তো তাদেরও বাচ্চাদের এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

প্রভাব:

এসব ফ্যামিলির শিশুরা সবসময় হিনম্মন্যতায় ভোগে এবং মনে করে তাদের জীবনের ওপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সবসময় শাস্তির ভয়ে নত হয়ে থাকার ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা, ঘৃণা, অভিমান, রাগ, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ পরায়ণতা, এসব বাজে ব্যাপারগুলো তৈরি হয়। এসব বাচ্চা পরবর্তীতে বড় হয়েও জীবনের প্রতি কোনরকম দায়দায়িত্ব বোধ করেনা, না তাদের কোন লক্ষ্য থাকে। এরা সর্বদা এই মটো নিয়েই বড় হয় যে “আমার বড়দের আদেশ নিষেধ মেনেই চলতে হবে এবং এছাড়া আমার আর কোন অপশন নেই”।

২. এই ধরনের বাবা-মা রুমে এসে বলবে “বাবু, বাথরুমে কাপড় ভিজিয়ে রাখা আছে, ধুচ্ছোনা কেন?”, তখন যদি বাচ্চাটা সামান্য অনুযোগ দেখিয়েও বলে যে “এখন কাপড় ধুইতে গেলেতো প্রোগ্রাম মিস হয়ে যাবে”, তাহলে সে প্রশ্রয় দিয়ে বলবে “আচ্ছা আজকের মত থাক, কিন্তু এরপর যখনকার কাজ তখন করবে, আজ আমি ধুয়ে দিচ্ছি”।

এই ধরনের বাবা-মা সন্তানদের প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন যেন তারা নিজেদের মত করে বড় হতে পারে। এরা তাদের সাথে মনোমালিন্য এড়ানোর জন্য যেকোন ধরনের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিতে চায়না কারণ তারা নিজেদের মধ্যে দেয়াল ও দূরত্ব তৈরি করতে ভয় পায়। সবসময় না ভেবেই সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করে যায়, কারণ- তাদের কাছে সব সিদ্ধান্তের মূলে সন্তানের খুশি, তারা চায় না তাদের বাচ্চাদের কাছে “খারাপ” বাবা-মা হতে অথবা তাদের কোনভাবে যেন ঘৃণা না করে, এজন্য বাচ্চাদের নিজেদের ইচ্ছেমত নিয়ম তৈরি করা এবং তাদের ইচ্ছামাফিক সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া। তারা তাদের সন্তানদের অন্ধের মত ভালোবাসে এবং বিনিময়ে তাদের ভালোবাসাও প্রত্যাশা করে। কিন্তু এর প্রতিদানে তারা যে ব্যবহারটা পায়, সেটাকে সহজ ভাষায় আমরা “বেয়াদবি” বলি।

প্রভাব:

যেহেতু তাদের উপর কোন নিয়ম নেই, তাই বাচ্চারাও কনফিউজড হয়ে যায় যে কেমন ব্যবহার করবে। তারা ভালোবাসা বলতেই আসলে বোঝে “যা চাওয়া তাই পাওয়া আর নিজেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা”। ফলে তাদের স্কুল এবং বাসার আদবকায়দার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারেনা। তারা যেকোন ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কারণ- তারা জানে বড়রা তাদের মাফ করে দিবে। এবং এজন্য বাসার প্রশ্রয় ক্লাসের নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে ঝামেলা হয়। তারা সর্বদা এই ভাবনা নিয়ে বড় হয় “আমি যেমন খুশি তেমন চলবো, যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা আমার আছে”।

৩. এই টাইপের অভিভাবকেরা রুমে ঢুকে প্রথমে বাচ্চার কাছে যাবে, তারপর জিজ্ঞেস করবে “তোমার না আজকে কাপড় ধোয়ার কথা ছিল?” তখন যদি বাচ্চা উত্তর দেয় “কিন্তু এখন ধুতে গেলে প্রোগ্রামটা মিস হয়ে যাবে”। তখন রাগ না দেখিয়ে শান্তভাবে জবাব দিবে “আচ্ছা ঠিকাছে কিন্তু ভিজিয়ে রাখলে ওগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, তুমি প্রোগ্রাম শেষে যত দ্রত সম্ভব ওগুলো ধুয়ে ফেলবে”।

এক্ষেত্রে অভিভাবক এবং সন্তান দুজনই স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ পেল। এই ধরণের বাবা-মা সমস্যা সমাধানে সন্তানের মতামত চায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি তাদের দায়িত্বও পালন করে। কখনো কখনো সন্তান বাবা-মার আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে রাগ বা শাসনের বদলে সেটা নিয়ে আলোচনা করাকে শ্রেয় মনে করে। এরা মনে করে ভুল থেকেই শেখার সুযোগ হয়। তারা এসব ভুলগুলো থেকেই সন্তানের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং দায়িত্ববোধের শিক্ষা গ্রহণ করায়। তারা অভিভাবক এবং সন্তানের মাঝে আত্মসম্মানের একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে, এবং এভাবেই ধীরে ধীরে তারা নিজ সন্তানের রোল মডেল হয়ে যায়। তারা তাদের নিয়মে ঠিক থাকে, এবং সন্তানকে বোঝায় তার দায়িত্ব কি।

প্রভাব:

এর ফলে বাচ্চারা বুঝতে পারে তারা একটা পরিবারের সদস্য, যেখানে সবাই সবাইকে সহযোগীতা করবে, তাদেরও সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে এবং সেটার প্রভাব পুরো পরিবারে পড়বে। এতে তারা দায়িত্ব নিতে শেখে এবং এর বিনিময়ে স্নেহ প্রত্যাশা করে। তারা যে মনোভাব নিয়ে বড় হয় তা হলো, “আমি ভুল করলেও শুধরে নেব, কারণ আমিই আমার কাজের জন্য দায়ী। আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে এবং পরিবারের সবাই একসাথে সবার সহযোগীতায় সমস্যার সমাধান করবো”।

বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।

 908 total views,  1 views today

What People Are Saying

Facebook Comment