বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয়। তারা যা দেখে বা শুনে সেগুলোই অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। মূলত চারপাশের পরিবেশ থেকেই তারা শিক্ষা লাভ করে থাকে। একটি বাচ্চার প্রাথমিক শিক্ষার ভিত গঠিত হয় পরিবার থেকে। সেখানেই সে আদর্শ মানুষ হওয়ার প্রাথমিক দীক্ষাটা পেয়ে থাকে।তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্রও আমরা দেখতে পাই, যেমন কলহময় পারিবারিক অবস্থা, অসহনশীল সামাজিক পরিবেশ এবং প্রপার প্যারেন্টিং-এর অভাবে বাচ্চা (Child) হয়ে উঠে অবাধ্য। অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চার সহিংসতার মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। বাচ্চা হয়ে উঠেছে উগ্র মেজাজী আর তার ধ্বংসাত্মক কাজকর্মে সবাই চিন্তিত। এই রকম পরিস্থিতিতে অবাধ্য বাচ্চাকে সুপথে আনতে অভিভাবকদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়।
যাই হোক, আজ আমরা বাচ্চার সহিংস আচরণের কারণ এবং তা সংশোধনের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
১। ঈর্ষাভাব দূর করুন
অনেক সময় দেখা যায় যে, বাচ্চা (Child) তার নবজাতক ভাই বা বোনকে সহ্য করতে পারে না। এর কারণ হিসাবে ধরা যায়, নবজাতকের প্রতি সবার অতিরিক্ত কেয়ার বাচ্চাকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। তখন সে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, ভাংচুর, এমনকি নবজাতকেরও ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। ভাবছেন এই অবস্থায় বাচ্চাকে কিভাবে সামলাবেন?
সেক্ষেত্রে বাচ্চার সাথে সরাসরি কথা বলুন। তাকে বুঝিয়ে বলুন, সে আপনাদের কাছে কতটা গুরত্বপূর্ণ। আরও বুঝিয়ে বলুন, তার ছোট্ট ভাই বা বোনটা এখন অনেক ছোট আর অসহায়, সে নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না। তাই সবার উচিত বাবুটার প্রতি যত্নশীল হওয়া। আর এক্ষেত্রে সেও তাদের হেল্প করতে পারে। এবং সে যখন এই বাবুটার মতো ছিলে, সবাই তাকেও এইভাবে যত্ন করতো। তাকে ছোট্ট বাবুটার সাথে খেলা করতে এবং টুকটাক কাজ করতে উৎসাহিত করুন। ফলে একসময় আস্তে আস্তে তার মনের ঈর্ষাভাব দূর হয়ে যাবে।
২। নিয়ম–শৃঙ্খলা শেখান
আপনার সন্তান কেন এইরকম সহিংস আচরণ করছে? তার কারণ খুঁজে বের করুন। সে কি কোন কিছু নিয়ে বেশি ক্ষিপ্ত কিংবা কোন প্রভাবক তার এমন আচরণের কারণ হতে পারে, তা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করুন। বাসা বা স্কুলে তার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, কথা বলে কৌশলে তার সমস্যা জেনে নিন এবং যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করুন। এবং বাচ্চার অবাধ্যতা দূর করতে তাকে নিয়ম শৃঙ্খলা শেখান।
এছাড়াও সে এখন অনেক ছোট তাই তার সবকিছু মা-বাবার সাথে শেয়ার করতে হবে। আর যে কোন ব্যাপারে মা-বাবার কথা শুনতে হবে, সেটা যেন সে বুঝতে পারে এবং মেনে চলতে পারে সে ব্যবস্থা করুন। তবে সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে জোর করে কিছু শুনতে/করতে বাধ্য করবেন না। বরং আদর করে তাকে তার ভুল বুঝিয়ে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসুন। দেখবেন একসময় সে ঠিকই আপনার কথা শুনছে।
৩। ভাল কাজের জন্য পুরস্কৃত করুন
আপনার বাচ্চার মধ্যে আছে অসীম সম্ভাবনা আর তা যাতে ভাল কাজে ব্যয় হয় সেই চেষ্টা করুন। বয়স অনুযায়ী বাচ্চাকে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত করুন। তাকে ছবি আঁকা, গান শেখা এবং বাইরে মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে দিন।
সে ভাল কাজ করলে তাকে পুরস্কৃত করুন এবং খারাপ কাজের জন্য বয়স বিবেচনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করুন। তবে এক্ষেত্রে শাস্তি বলতে মারধোর বা রাগারাগি নয়। বরং তাকে এইভাবে শাস্তি দেয়া যেতে পারে যে, ‘তুমি আজ ফুলদানি ভেঙেছ সুতরাং এখন সরি বলো, না হলে আজ তোমার পছন্দের কার্টুন দেখতে পারবে না।’ এতে যদি সে ক্ষমা চায় এবং এই কাজ আর করবে না বলে কথা দেয়, তবে তাকে ছাড় দেয়া যেতে পারে।
৪। সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করুন
বাচ্চারা অনেক সময় হরর মুভি এবং সহিংসতামুখী সিরিয়ালের ভক্ত হয়ে পড়ে। দেখা যায় এই সব থেকে প্রভাবিত হয়ে তারা মারামারি, ভাংচুর ইত্যাদি করে থাকে। আর তাইতো সময় থাকতে তার এই সব সহিংসতা সম্বলিত মুভি এবং সিরিয়াল দেখা বন্ধ করুন। বরং তাকে ভালো শিশুতোষ মুভি এবং শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখতে দিন।
এছাড়াও বাচ্চার হাতে মোবাইল, ট্যাবলেট, ভিডিও গেমস ইত্যাদি তুলে না দিয়ে তাকে গল্পের বই, বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনী, মনীষীদের জীবনী ইত্যাদি তুলে দিন। বাচ্চার হাতে পিস্তল জাতীয় খেলনা না দিয়ে, তাকে লারনিং গেমস যেমন- রুবিক্স কিউব, সুডোকু, বিভিন্ন পাজল সমাধান, স্ক্রাবল গেমসের উপকরণ ইত্যাদি তুলে দিন। সময় করে বাচ্চাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান। আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে আপনার বাচ্চার সরল মন আরও সজীবতায় ভরে উঠবে।
৫। রাগারাগি বা মারধোর নয়
বাচ্চার কাজে বিরক্ত হয়ে রাগের বশে তাকে তৎক্ষণাৎ রাগারাগি বা মারধোর করবেন না। কথায় আছে ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।’ আর রাগের সময় বলা কথা বা কাজের জন্য হয়তো বাচ্চা (Child) আরও দূরে সরে যেতে পারে। তো সেক্ষেত্রে আপনি সময় নিয়ে নিজের মাথা ঠাণ্ডা করুন এবং বাচ্চাকেও ঠাণ্ডা হতে দিন।
তারপর বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলুন যে, তুমি এই ধরনের কাজ করে কতটা ক্ষতি করেছ তা কি তুমি জানো? আর তোমার এই কাজে আমি যে কষ্ট পাই তা কি তুমি বুঝো? আর ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ করবে না। এবং এক্ষেত্রে সে যদি তার খেলনা বা জিনিসপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে, তবে তা তাকেই গুছিয়ে রাখতে দিন।
৬। অন্যের দুঃখ অনুভব করতে শেখান
ধরুন আপনার বাসায় কোন বাচ্চা বেড়াতে আসলো। এবং আপনার সন্তানের খেলনা নিয়ে খেলতে লাগলো। আর এই ব্যাপারটা আপনার সন্তান ভালভাবে নিল না। সে অতিথি বাবুর হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
এক্ষেত্রে আপনি আপনার সন্তানকে এই বলে বুঝাতে পারেন যে, তুমি তো তোমার ভাইয়ার/বোনের সাথে খেলনা শেয়ার করে খেলা করো, তেমনি এই বাবুটার সাথেও তো খেলতে পারতে। ধরো তোমাকে যদি কেউ এই ভাবে ধাক্কা দিত, তাহলে তুমিও তো ব্যথা পেতে, তাইনা? আর এতে বাবুটা যে কষ্ট পেয়েছে তা কি তুমি বুঝতে পারছো! এভাবে বুঝাতে বুঝাতে বাচ্চা একসময় বুঝতে শিখবে এবং তার সহিংস আচরণও সংশোধনের পথে যাবে।
৭। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান
বাচ্চার সহিংস আচরণ যদি কোনভাবেই সংশোধন করতে না পারেন, তবে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। অনেক সময় অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চারা প্রচণ্ড জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের হয়ে থাকে। এছাড়াও দরকার পড়লে বাচ্চাকে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি করাতে হবে। আর এক্ষেত্রে অনেক সময় মা-বাবাসহ পারিবারিক কাউন্সেলিংও করতে হতে পারে। যা আপনার এবং বাচ্চার উভয়ের জন্যই ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করবে।
আপনার সন্তান অটিজমে আক্রান্ত নয় তো? সচেতন হোন
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
আপনার সন্তান আপনার অস্তিত্বের অংশ। তার ভালমন্দ আপনার থেকে কেউ কখনোই বেশি বুঝবে না। আর তাইতো অবাধ্য বাচ্চার (Child) সহিংস আচরণ রোধ করতে বন্ধুর মতো তার পাশে থাকুন সবসময়।
1,461 total views, 1 views today