আমাদের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তামজীদ। বয়স সবে মাত্র আড়াই বছর। সারাদিন গুটি গুটি পায়ে ঘুরে বেড়ায় আর আপনমনে খেলা করে। তো সেদিন পাশের বাসার তিন বছরের নিশাত তার আম্মুর সাথে বেড়াতে এসেছিল। তামজীদ খুশিমনেই নিশাতের সাথে খেলছিল। তো খেলার মাঝে হঠাৎ চিৎকার। গিয়ে দেখা গেল দু’জনেই সমানতালে চিৎকার করছে আর নিশাত তামজীদকে আঘাত করছে। কারণ হিসেবে জানা গেল তামজীদ তার টেডি বিয়ারটা নিশাতকে দিবে না, আর নিশাত সেটা কেড়ে নিবেই। একপর্যায়ে রাগান্বিত নিশাত মেঝেতে শুয়ে হাত পা ছুড়ে কান্না জুড়ে দিলো। তাকে কোনভাবেই আর শান্ত করা যাচ্ছিল না। অতঃপর বিব্রত হয়ে নিশাতের আম্মু তাকে জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে গেলেন।
নিশাতের মতো আপনার সন্তানও কী এইরকম ভাবে রেগে যায়? জেদ করে একটানা চিৎকার করতে থাকে কিংবা রেগে গিয়ে হাত পা ছুড়ে অন্যকে আঘাত করে বসে। তাহলে এই লেখাটা আপনারই জন্য।
ছোট্ট বাচ্চারা কেন জেদ করে অতিরিক্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ করে আসুন সেটা জেনে নিই।
টেম্পার ট্যান্ট্রাম (Temper Tantrum)
নবজাতক থেকে চার বছর বয়সের আগ পর্যন্ত একটি শিশু একেবারে নিতান্তই অবুঝ! তখন তার একরোখা আচরণ মূলত তার রাগ আর হতাশার বায়োলজিক্যাল বহিঃপ্রকাশ। এসময় সে হাত পা দিয়ে আঘাত করে, একটানা চিৎকার করে, দম আটকে কাশতে কাশতে বমি করে দেয় কিংবা মেঝেতে উল্টো হয়ে শুয়ে পরে হাত পা ছুড়ে কান্নাকাটি করতে পারে। এগুলোকে বিশেষজ্ঞের ভাষায় টেম্পার ট্যান্ট্রাম (Temper Tantrum) বলা হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা হল-কাউকে নিজের কিছু ধরতে দিতে চায়না, কারো সাথে নিজের খেলনা শেয়ার করতে চায়না কিংবা একই বয়সের অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে না। মূলত দুই থেকে চার বছর বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে টেম্পার ট্যান্ট্রাম বেশী দেখা যায়।
টেম্পার ট্যান্ট্রাম (Temper Tantrum) কেন হয়?
মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex) আমাদের মানবিক আবেগ অনুভুতির প্রকাশ ও সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেক্ষেত্রে এটি মূলত চার বছর বয়স থেকে পূর্ণতা লাভ করতে শুরু করে। আর ঠিক এ কারনেই চার বছরের আগ পর্যন্ত বাচ্চারা মানবিক আবেগ ও সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অপরিপক্ব হয়ে থাকে। এই বয়সে বাচ্চাদের মানবীয় আবেগের প্রকাশ ও সামাজিক দক্ষতা সেভাবে বিকশিত হয় না। সে তার মনের ভাব সেভাবে প্রকাশ করতে কিংবা অন্যরা কী বুঝাতে চাচ্ছে তাও ভালভাবে বুঝতে বা অনুধাবন করতে পারে না। আর তাইতো চার বছরের আগ পর্যন্ত এই ধরনের অবুঝ আচরণ করাকে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হয়।
একটি বাচ্চার ক্ষেত্রে টেম্পার ট্যান্ট্রাম (Temper Tantrum) বা অতিরিক্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ যেসব কারণে হয়ে থাকেঃ
১। সেভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না এবং অন্যের অনুভূতিও বুঝতে পারে না।
২। স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে না পারলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
৩। অনেকসময় কিছু বিষয় সে তেমনভাবে বুঝিয়ে বলতে পারে না।
৪। বাচ্চা হয়তো অনেক সময় ক্ষুধার্ত থাকে এবং ক্লান্তিবোধ করে।
৫। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একঘেয়েমি এবং খারাপলাগা কাজ করতে পারে।
এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ছোট্ট বাচ্চার প্রতি সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। তার প্রয়োজনীয় সকল দিকসমূহ পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
টেম্পার ট্যান্ট্রাম (Temper Tantrum) এর ক্ষেত্রে শিশুর মনে যেসব ভাবনা কাজ করে:
এই বয়সে বাচ্চার কোমল মন কোন যুক্তি মানে না। আশেপাশের জগতটা তখন ওদের কাছে অনেক বেশী বিভ্রান্তিকর ও সুন্দর। আমাদের দৃষ্টিতে যা স্বাভাবিক ঠিক তাই ওদের দৃষ্টিতে মজার হয়ে ধরা দেয়। যেমন ধরুন তার দৃষ্টিতে- বাথরুমের কল ছেড়ে রাখলে কি সুন্দর ঝিরঝির করে পানি পরে, আম্মু কেন সেটা বন্ধ করে দেবে? আর সেক্ষেত্রে তো রাগ হতেই পারে। আবার হয়তো দোকানে গিয়ে যে খেলনাটা তার ভাল লেগেছে সুতরাং সেটা তাকে কিনে দিলেই পারে, আর না দিলে সে তো জেদ করতেই পারে। কিংবা পাশের বাসার তামজীদের টেডি বিয়ারটা তার ভাল লেগেছে। সুতরাং সে সেটা কেড়ে নিতেই পারে, এতে আম্মু কেন তাকে বকাঝকা করবেন!
শিশুর মনোজগতে এইরকম বিভিন্ন ভাবনা কাজ করে, ফলে সে তার ভুল আচরণগুলো বুঝতে পারে না। আর তাইতো অতিমাত্রায় অবুঝ হয়ে থাকার কারনে ভালমন্দের পার্থক্যও ধরতে পারে না। আর এই ব্যাপারগুলো তার বয়স অনুযায়ী একবারেই সাধারণ বিষয়। আর এই বয়সে এই ধরনের আচরণের জন্য তাকে কোন প্রকারের শাস্তিই দেয়া যাবে না। বরং কীভাবে তার এই আচরণগুলোকে সামাল দিয়ে তার বড় হওয়ার পথটাকে সাবলীল করা যায় সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।
পরবর্তী পর্বে পড়ুনঃ শিশুর টেম্পার ট্যান্ট্রাম (Temper Tantrum) বা অতিরিক্ত রাগ নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে? (২য় পর্ব)
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,935 total views, 1 views today