সাধারণত জন্মের বেশ কয়েকমাস পর থেকেই বোঝা যায় শিশুরা লাজুক হবে নাকি অনেক বেশি চঞ্চল হবে। যখন থেকে শিশুদের এই ব্যক্তিত্বের ধরণটা বোঝা যায় তখন থেকেই মূলত শিশুর ব্যক্তিত্বের ধরণ বুঝে তাকে সামলাতে হয়। এতে শিশুর বেড়ে উঠা যেমন সুন্দর হয় তেমনি প্যারেন্টিং ও সহজ হয়ে ওঠে। গবেষকরা বলছেন টডলার (১-৩ বছরের বাচ্চা) বয়স থেকেই শিশুর ব্যক্তিত্বের ধরণ বোঝা যায়। এবং এই বয়সে যদি আপনি সন্তানের ব্যক্তিত্বের ধরণ বুঝে তার সাথে সুন্দর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন তাহলে পরবর্তী সময়ে তার সঠিক খেয়াল রাখাও আপনার জন্য বেশ সহজ হয়ে যাবে। আজকে আমরা জেনে নিবো টডলার পার্সোনালিটি-এর ধরণ ও সেই ধরণ অনুযায়ী শিশুদের যত্ন নেয়া প্রসঙ্গে।
সাধারণ পৃথিবীতে ৩ ধরণের টডলার পার্সোনালিটি সম্পন্ন শিশু পাওয়া যায়।
১। ইজিগোয়িং। এরা কিছুটা সহজ। সব কিছুর সাথে মিশতে পারে। নিজেকে মানিয়েও নিতে পারে।
২। লাজুক। এই টডলার পার্সোনালিটি সম্পন্নরা সহজ হতে একটু সময় নেয়। চুপচাপ থাকে। বেশ চিন্তাশীলও মনে হয় এদের।
৩। অতিচঞ্চল। অনেক বিদেশী গবেষক এই ধরণের টডলার পার্সোনালিটি’কে ‘ওয়াইল্ড’ পার্সনালিটির সাথে তুলনা করেন।
১। ইজিগোয়িং, সহজ ও সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো বাচ্চা
বেশিরভাগ টডলারই ইজিগোয়িং হয়ে থাকে। এরা সাধারণত সব ধরণের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে। একই সাথে বেশ গোছানো হয়। কিছু বাচ্চা থাকে না, যারা বাবা-মা না থাকলেও দাদা-দাদি বা নানা-নানির সাথে বেশ লম্বা সময় ধরে থাকতে পারে; এদেরকেই মূলত ইজিগোয়িং বলা যায়। এরা যেকোন নতুন পরিস্থিতির জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ, আলাদা আলাদা মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। এবং নতুন পরিবেশ এরা বেশ পছন্দও করে। এই ধরণের বাচ্চাদের নিয়ে আপনার আলাদা করে চিন্তা করা লাগে না।
এই ধরণের বাচ্চাদের সামলানোর জন্য সাধারণ প্যারেন্টিং-ই যথেষ্ট। তবে আলাদাভাবে বাবা-মায়ের মনোযোগ আকর্ষণের মনোভাব এদের মাঝে থাকে না বলে অনেক বাবা-মাই তাদেরকে স্বভাবিকের একটু কম সময় দিয়ে থাকেন। গবেষকরা এই বিষয়টি নিয়ে বাবা-মায়েদের একটু মনোযোগী থাকার কথা বলেন। মনোযোগ চায় না বলে কোনভাবেই যেন তারা অবহেলার শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। “ও তো আছেই ওর মতো, আমি অন্য কাজ করি” আপনার অজান্তেই এই ধরণের মানসিকতা একসময় তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে সন্তানকে যতটুকু সময় দেয়া উচিত ততটুকু সময় যেন ওর জন্যও বরাদ্ধ থাকে।
২। লাজুক বাচ্চা
সাধারণত ৯ মাসের মধ্যেই শিশুরা হাসতে শিখে যায়। ৯ মাসের মধ্যেই মৌখিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শিশুরা বাবা-মা ও অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। তবে একটু লাজুক ধরণের বাচ্চাদের মাঝে এই ব্যাপারগুলো একটু দেরিতে দেখা দেয়। তারা সাধারণত একা, চুপচাপ ও নিজের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে এবং বাবা-মাকেই সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করে। একটু লাজুক হওয়ায় এরা হাঁটা শিখতেও স্বাভাবিক বাচ্চাদের চেয়ে একটু বেশি সময় নেয়। তাদের এই লাজুক স্বভাব কিন্তু মোটেও অস্বাভাবিক বা কোন সমস্যা না। বরং তাদের ব্যক্তিত্বের ধরণটাই এমন। তারা এভাবে থাকতেই পছন্দ করে ও এভাবেই তার চারপাশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে।
সে কম কথা বলছে, বাড়িতে কোন অতিথি আসলে সে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছে না; এইসব বিষয়ে অকারণ চিন্তা করার কোন দরকার নেই। অনেকেই সন্তানের এই লাজুক স্বভাবকে অসামাজিকতা হিসেবে দেখে শিশুকে জোর করে সামাজিক করার চেষ্টা করেন, সে না চাইলেও জোর করে তাকে আত্মীয় স্বজনের সামনে এনে বেশি বেশি কথা বলাতে চেষ্টা করেন। শিশু নিজেকে গুটিয়ে নিলে হয়তো দু-একটা কথাও শুনিয়ে দেন। এটা মোটেও উচিত না। আপনাকে প্রথমেই বুঝতে হবে আপনার সন্তান অসামাজিক বা অস্বাভাবিক না। কম সংখ্যক ও নিজের পরিচিত মানুষ ছাড়া অন্যদের সাথে খুব একটা না মেশাটা তার ব্যক্তিত্বেরই অংশ। আমেরিকান পেডিয়াট্রিশিয়ান হার্ভে কার্প এই ধরণের বাচ্চাদের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, কোন কিছুর প্রতি যদি তাদের বিন্দুমাত্র অনীহাও থাকে তাহলে তারা সেটা থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করবে।
যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন কিছুর প্রতি আপনার লাজুক টডলার নিজে থেকে আগ্রহ না দেখায় ততক্ষণ পর্যন্ত জোর করে তার মাঝে আগ্রহ জন্মানোর চেষ্টা করবেন না। তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন ও তার আগ্রহ জন্ম নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। সোজা কথা, তাকে সব কিছুর জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি নিজেকে তার বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করতে পারলে। এমনভাবে তার কাছে নিজেকে তৈরি করুন, সে যেন তার সকল ধরণের অনীহা ও খারাপ লাগার কথা আপনার কাছে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে।
৩। অতি চঞ্চল টডলার
প্রতি ১০ জন বাচ্চার মধ্যে একজন বাচ্চা অতি চঞ্চল হয়ে থাকে। পেডিয়াট্রিশিয়ান হার্ভে কার্প এই ধরণের বাচ্চাদের নাম দিয়েছেন ‘ওয়াইল্ড চাইল্ড’। বুঝতেই পারছেন, এই অতি চঞ্চল বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা কঠিন। এদেরকে ঠিক করে ধরেবেঁধে রাখা যায় না। সবসময় অনেক বেশি অ্যাক্টিভ থাকে এরা। বলা হয়ে থাকে, কারো একটা ওয়াইল্ড চাইল্ড থাকা মানে তার আসলে কয়েকটা বাচ্চা আছে। এদেরকে তুলনা করা যেতে পারে বাউন্স বলের সাথে। তারা অনেক বেশি এনার্জেটিক, অ্যাক্টিভ, অস্থির, অধৈর্য্য থাকার পাশাপাশি তাদের মাঝে অভিমান ও স্পর্শকাতরতাও থাকে বেশি। এবং অতি এনার্জি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে শান্ত হয় না।
এই ধরণের বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদেরকে সবসময় অ্যাক্টিভ থাকতে দিতে হবে। তাদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রেখে তাদের এই উদ্যমতাকে কাজে লাগাতে হবে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেন তাদের এনার্জি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদেরকে বেশি বেশি করে মাঠে খেলতে দেয়া উচিত। এই ধরণের বাচ্চাদের উপর অনেক বাবা-মায়েরাই বিরক্ত হন, প্রচুর বকাঝকা করেন; এক্ষেত্রে তার উদ্যমতা না কমে বরং বেড়ে যেতে পারে আবার তার ভেতর বাড়তে পারে অভিমানও। তার উদ্যমতাকে লালন করলে এই উদ্যমতাই তার ভবিষ্যতের জন্য দারুণ কিছু নিয়ে আসতে পারবে। তবে হ্যাঁ, তার যেসব আচরণ একেবারেই মেনে নেয়া যায় না, কিংবা যেসকল আচরণ অশোভন; সেগুলো সম্পর্কে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে।
প্রতিটি শিশুই আলাদা, সবারই রয়েছে নিজস্ব সুন্দর বৈশিষ্ট
প্রতিটি শিশুই আসলে আলাদা। তবে আচরণের মিল থাকার কারণে সাধারণত ২-৩ বছরের শিশুদেরকে টডলার পার্সোনালিটি’র এই তিনটি সাধারণ ধাপে ফেলা যায়। বড় হতে হতে তাদের ব্যক্তিত্বের আরো অনেক ধাপ সামনে আসে। সেটা ভিন্ন আলোচনা। তবে আপনি চাইলে শিশুদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের ধরণ নিয়ে এই লিংক থেকে জানতে পারেন।
সবচেয়ে বড় কথ হচ্ছে, আপনার শিশুর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখবেন, শিশুরা ফুলের মতো! এবং সবারই আছে নিজস্ব সুন্দর কিছু ঘ্রাণ। তাদের এই নিজস্বতা নিয়েই তাদের সাথে মিশতে হবে, তাদের নিজস্বতার সাথে মিলিয়েই তাদের বড় করে তুলতে হবে। কোন বাচ্চার নিজস্বতাকে জোর করে পরিবর্তন করাটা ঠিক নয়। এতে হিতে-বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,964 total views, 3 views today