ছোট বেলায় চুম্বক পছন্দ করতো না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। কি অদ্ভুত একটি বস্তু তাই না! ধাতব কোন কিছুর সাথে লাগালেই এটি লেগে যায়। আবার কোন কোন চুম্বক দুটি একসাথে লাগালেও এটি লেগে যায়। আমার এখনো মনে আছে ছোট বেলায় বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভেঙ্গে চুম্বক খুঁজে বেড়াতাম। ছোট বেলায় চুম্বক সংগ্রহে রাখাও একটি দারুণ মজার ব্যাপার ছিল।
চুম্বকের ইতিকথা-
চুম্বক কীভাবে প্রথম আবিষ্কার হয় এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য না থাকলেও শোনা যায় অনেক অনেক বছর আগে কেউ একজন হাঁটার সময় তার পায়ের জুতোর ধাতব অংশে একটি পাথর লেগে যায়। এবং সেখান থেকেই এই বিস্ময়কর পাথর সম্পর্কে মানুষ গবেষণা করে চুম্বক আবিষ্কার করে। ধারনা করা হয় প্রথম যে চুম্বক আবিষ্কার হয়েছিল সেটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক চুম্বক। ম্যাগনেটাইট বা লোডস্টোন নামক পাথরের ভেতর সর্বপ্রথম চুম্বকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
‘লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার’ সুইজারল্যান্ডে খুঁজে পাওয়া এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চুম্বক। যেটি সাধারণ ফ্রিজ ম্যাগনেটের তুলনায় যার চুম্বকত্ব ৪০০ গুণ বেশি। আবার অন্যদিকে সবচেয়ে শক্তিশালী চুম্বকটি রয়েছে ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, এবং এই চুম্বক ‘লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার’ চুম্বকের তুলনায় আকারে অনেক ছোট। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে প্রাকৃতিক চুম্বক পাওয়া যায় স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে।
চুম্বকের চমক বিজ্ঞানবাক্স-
চুম্বক নিয়ে এ যাবত পৃথিবীতে অনেক ধরণের এক্সপেরিমেন্ট রয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্সেও আছে দারুণ দারুণ ২৬ টি এক্সপেরিমেন্ট। এছাড়াও আছে কিছু মুল্যবান চুম্বক। চুম্বকের ডোমেইন, তড়িৎ চুম্বক তত্ত্ব, আকর্ষণ, বিকর্ষণ এই কঠিন তত্ত্বগুলো যে আসলে খুব মজার সেটি চুম্বকের চমক বিজ্ঞানবাক্সে জানতে পারবে। আজকে চুম্বক নিয়ে চুম্বকের চমক বিজ্ঞানবাক্সের মজার কিছু এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে চল জেনে আসি-
ম্যগনেটিক নিক্তি-
ম্যাগনেটিক নিক্তি চুম্বকের চমক বিজ্ঞানবাক্সের একটি এক্সপেরিমেন্ট যেটা ২৪ নাম্বার পরীক্ষণে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা এখন জানবো কিভাবে ম্যাগনেটিক নিক্তি তৈরি করা যায়।
চুম্বকের চমক বিজ্ঞানবাক্স থেকে প্রথমে ৩ টি রিং ম্যাগনেট, পেন্সিল এবং পেন্সিল সাইজের লম্বা এক টুকরো সাদা কাগজ নিতে হবে। এখন পেন্সিলটাকে একটা কার্ড বোর্ডে দাড়া করাতে হবে। পরিমাপের জন্য সাদা কাগজে দাগ কেটে নিতে হবে। এখন সাদা কাগজটাকে পেন্সিলের গায়ে লাগাতে হবে। এবার আমরা ম্যাগনেটিক স্প্রিং যেভাবে তৈরি করেছিলাম সেভাবে ৩ টি ম্যাগনেট পেন্সিলের ভিতর দিয়ে আটকে দিব। তাহলে এখন যদি উপরের রিং ম্যাগনেটের উপর কোন বস্তুকে রাখা হয় সেটি নিচের দিকে নেমে যাবে এবং যে দাগে এসে থামবে সেই দাগ অনুযায়ী আমরা চাইলে তার ভর মাপতে পারব বা ওজন মাপতে পারব।
আমরা যত বেশী ভারী বস্তু উপরের স্প্রিং ম্যাগনেটের উপর রাখব স্প্রিংটি তত বেশী নিচে নেমে যাবে এবং যত হাল্কা বস্তু রাখবো তত কম নামবে। এভাবে চাইলেই আমরা বিভিন্ন বস্তুর ওজন তুলনা করতে পারি।
ম্যাগনেটিক সুইচ-
তোমরা নিশ্চয়ই সবাই জানো সুইচ দিয়ে লাইট বা ফ্যান অন অফ করতে হলে প্রথমে আমাদের সুইচের কাছে গিয়ে সুইচটাকে স্পর্শ করতে হয়। সুইচে চাপ দিয়ে লাইট অন করা যাবে অথবা অফ করা যাবে। কেমন হত যদি হাতের কোন স্পর্শ ছাড়াই দূর থেকে একটি সুইচ অন অফ করা যেত? তাহলে আমরা দূর থেকেই একটি বাতিকে জ্বালাতে কিংবা নেভাতে পারতাম। এখন আমরা ঠিক এই কাজটা সম্পর্কেই জানবো। এই কাজটি করার জন্য আমাদের লাগবে একটা রিড সুইচ। এই সুইচটি আসলে একটি ম্যাগনেটিক সুইচ। যদি আমরা এই সুইচের কাছে একটি চুম্বক নিয়ে আসি তাহলে সুইচটা অন হয়ে যায় আর চুম্বকটাকে দূরে নিয়ে গেলে আবার অফ হয়ে যায়।
তো এই পরীক্ষাটি করার জন্য আমরা রিড সুইচকে ব্যাটারির সাথে কানেকশন দিব। তারপর তার সাথে আমরা একটি এলইডি যুক্ত করে দিব। এখন বিজ্ঞানবাক্সে থাকা ম্যাগনেটটাকে কাছে আনলেই এলইডি জ্বলে উঠবে আবার দূরে নিয়ে গেলে এলইডি নিভে যাবে। তারমানে এই রিড সুইচটা একটি সাধারণ সুইচের মতই কাজ করছে কিন্তু স্পর্শ করে চাপ দেয়ার বদলে চুম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে আমরা এটাকে অন করতে পারি আবার অফ করতে পারি। মজার না ব্যাপারটা। তো আসলে আমরা এই রিড সুইচকে কিভাবে ব্যবহার করতে পারি, এই রিড সুইচকে আমরা চুম্বক ক্ষেত্র নির্দেশক সেন্সর হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। তাহলে এই সুইচ অন হওয়ার মাধ্যমে আমাকে জানান দিবে যে আশেপাশে চুম্বক ক্ষেত্র আছে কিংবা নাই। যদি থাকে তাহলে সুইচটা অন হয়ে যাবে আর যদি না থাকে তাহলে অফ হয়ে যাবে। অদ্ভুত না ব্যাপারটা!
চুম্বকের বলরেখা-
আমরা জানি চুম্বক একটি লোহার পেরেক কে আকর্ষণ করতে পারে। আবার একটা চুম্বক আরেকটা চুম্বককেও আকর্ষণ করতে পারে তবে সেটা হয় কেবল বিপরীত মেরুর বেলায়। একটি চুম্বকের দক্ষিন মেরু অন্য আরেকটি চুম্বকের উত্তর মেরুকে আকর্ষণ করতে পারে। আর যদি সম মেরু হয় তাহলে এরা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে অর্থাৎ দূরে ঠেলে দিতে চায়। এই ব্যাপারগুলো চুম্বক বলরেখা দিয়ে খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
এই বলরেখা পরীক্ষাটা করার জন্য আমাদের লাগবে একটি দণ্ড চুম্বক এবং কিছু লোহার গুড়া। যেগুলো চুম্বকের চমক বিজ্ঞানবাক্সে দেয়া আছে। আমরা এই দণ্ড চুম্বকটাকে যদি একটি সাদা কাগজের নিচে রাখি এবং তার উপরে খুব ধীরে ধীরে যদি কিছু লোহার গুড়া ছিটিয়ে দেই তাহলে বলরেখা গুলো আমাদের সামনে দৃশ্যমান হবে।
তাহলে আমরা এখন খুব ধীরে ধীরে লোহার গুড়া গুলো কাগজের উপর ছিটিয়ে দিব। এবং খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে লোহার গুড়া গুলো এই কাগজের উপর ছিটিয়ে দেয়ার সাথে সাথে এরা কিছু রেখা বা লাইন তৈরি করছে। যদি খুব ভালো করে খেয়াল করো তাহলে এই ব্যাপারটাও বুঝতে পারবে যে এই রেখা গুলো চুম্বকের এক মাথা থেকে বের হয়ে অন্য মাথায় এসে ঢুকে যাচ্ছে। এবং তার সাথে আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে এই চুম্বকের দুই মাথায় কিন্তু রেখা গুলোর ঘনত্ব অনেক বেশি। তো এই যে রেখাগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি এইগুলোই হচ্ছে চুম্বকের আসল বলরেখা। এবং যে দুই মাথায় আমরা দেখতে পাচ্ছি রেখার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, এরাই হচ্ছে চুম্বকের দুই মেরু। এবং দেখেই কিন্তু মনে হচ্ছে এই দুই মেরুতে চুম্বকের শক্তি অনেক বেশি। ব্যাপার সত্যিই কিন্তু তাই।
আমরা যদি একটি দণ্ড চুম্বক নেই এবং তার এক প্রান্তে এই লোহার পেরেকটা ধরি তাহলে খুব সহজেই এই চুম্বকটা এই লোহার পেরেকটাকে ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু আমরা যদি লোহার পেরেকটা চুম্বকের মাঝামাঝি দেই তাহলে চুম্বক লোহার পেরেকটাকে ধরে রাখতে পারবে না। তারমানে মাঝখানে চুম্বকের শক্তি কম এবং পেরেকটাকে আকর্ষণ করতে পারে না। তাহলে বুঝলেতো চুম্বকের বলরেখা কেমন।
চুম্বকের চমক সত্য কিংবা মিথ্যা-
আমরা এবার চুম্বক দিয়ে আরেকটি মজার খেলা তৈরি করব। এই খেলায় যেসব প্রশ্নের উত্তর সত্য কিংবা মিথ্যা দিয়ে দেয়া যায় সেসব প্রশ্ন করে খেলাটি খেলা যাবে।
প্রথমে আমরা একটি পেরেককে তামার তার পেঁচিয়ে টেবিলের সাথে আটকে দিব এবং এটাই আমাদের ইলেক্ট্রো ম্যাগনেট। এবার আমরা একটি দন্ড চুম্বকের একপাশে সত্য এবং অন্যপাশে মিথ্যে লিখে সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে দিব। এবার যদি আমরা এই ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটে ব্যাটারি সংযুক্ত করি তাহলে তা চুম্বকে পরিণত হবে এবং দন্ড চুম্বকটি সত্য বা মিথ্যা কোন একটি প্রদর্শন করবে। যেমন এখন মিথ্যা দেখাচ্ছে। আবার আমরা যদি ব্যাটারির সংযোগ বিপরীত ভাবে দিই তাহলে দন্ড চুম্বকটি ঘুরে গিয়ে সত্য দেখাবে। এভাবেই চুম্বক দিয়ে মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট ও খেলা করা যায়। কি দারুণ, তাই না?
আরো পড়তে পারো- ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়ে যাও স্কুলে থাকতেই!
সবগুলি বিজ্ঞানবাক্স দেখে নাও এখান থেকে।
1,262 total views, 1 views today