একজন মানুষের সুন্দর আচরণ অন্যকে সম্মানিত করার পাশাপাশি সম্মানিত করে নিজেকেও। একই সাথে শিশুর সুন্দর আচরণ পারিবারিক অনুশাসন ও পারিবারিক শিক্ষার প্রতিফলনও বটে। আপনার সন্তানের সুন্দর আচরণ অন্যের কাছে আদতে আপনাকেও সম্মানিত করে। একই সাথে শিশুর সুন্দর আচরণ তার মাঝে মানবিকতা, আত্মবিশ্বাস, সামাজিকতাসহ আরো বেশ কিছু অসাধারণ গুণ গড়ে তোলে। অপরপক্ষে শিশুর বাজে বা খারাপ আচরণ মূলত পারিবারিক শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের আজকের ব্লগ শিশুর সুন্দর আচরণ নিয়ে। ছোট থেকে সন্তানকে শেখাতে হবে এমন ১০ টি আচরণ সম্পর্কে জানবো আজকে। একই সাথে শিশুর সুন্দর আচরণ কেন দরকার? শিশুর সুন্দর আচরণ কীভাবে গড়ে তুলবেন তাও জানবো।
শিশুর সুন্দর আচরণ গড়ে তোলা কেন জরুরী?
সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আমাদেরকে প্রতিদিন অনেক মানুষ, সামাজিক ব্যবস্থা ও আমাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে দায়িত্বশীলতার সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। ফলে আমাদের ভালো ও খারাপ আচরণের প্রভাব পড়ে আমাদের চারপাশের সবকিছুতে। এবং সেই প্রভাবের প্রতিফলন পড়ে আমাদের উপরেও। একটা ভালো আচরণ যেমন কোন কিছুতে একটা সুন্দর পরিবর্তন নিয়ে আসে তেমনি খারাপ আচরণ নিয়ে আসে একটু নেতিবাচক পরিবর্তন। নিয়মিত ভালো আচরণ মানবিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষ ও আত্মবিশ্বাসী মানুষও গড়ে তোলে। মূলত সন্তানকে ভালো আচরণ শেখাতে হবে নিজের জন্য ও তার চারপাশের পরিবেশকে ভালোবাসতে পারার জন্য।
ছোট থেকেই কী কী আচরণ শেখাবেন?
ভালো আচরণ অনেক রকম হতে পারে। মানুষ ধীরে ধীরে বড় হতে হতে এইসব শেখে। কিন্তু আপনি যদি ছোট থেকেই আপনার সন্তানের মাঝে নিচের ভালো আচরণগুলো গড়ে তুলতে পারেন তাহলে সে বড় হতে হতে আরো বেশি ভালো, সুন্দর ও মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।
থ্যাংক ইউ, সরি, প্লিজ; থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড
আর্লি চাইল্ডহুড স্পেশালিস্টরা এই তিনটি শব্দকে একসাথে বলেন, থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড। শুধু শিশুদের ক্ষেত্রেই না, ছোট-বড় যে কেউ এই তিনটি শব্দ ব্যবহারে নিজেকে সুন্দর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। ক্ষেত্র বিশেষে এই তিনটি শব্দ ব্যবহার যেমন অন্যের কাছে কাউকে অনেক বেশি ব্যক্তিত্ববান করে তোলে তেমনি নিজের মধ্যেও ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি করে। আপনার সন্তানকে অবশ্যই এই তিনটি শব্দের সঠিক ব্যবহার শেখাবেন। কাউকে ধন্যবাদ দেয়া, নিজের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা, এবং কাউকে বিনীতভাবে কিছু বলার ক্ষেত্রে এই শব্দগুলোর ব্যবহার অনেক ফলপ্রসূ। এই তিনটি শব্দকে ভালো আচরণের প্রতিনিধিও বলা চলে।
অনুমতি নেয়া
শিশুদের মাঝে অনুমতি নেয়ার বিষয়টি শুরুতে তেমন একটা কাজ করে না। আসলে তারা বিষয়টির সাথে ভালোভাবে পরিচিতই না। সব কিছুকে নিজের মনে করার একটা প্রবণতা তার ভেতরে থাকে। ফলে অনুমতি ছাড়াই অন্যের কোন বস্তু নিয়ে নেয়। একটু বড় হলে আপনার সন্তানকে অনুমতি নেয়ার ম্যানার শেখাতে পারেন। দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সম্পৃক্ততা আছে এমন যে কোন কাজে যেন সে আগে অনুমতি নিয়ে নেয়। কারোর কোন বস্তু ব্যবহারের আগে কিংবা কারো রুমে ঢোকার আগে কিংবা স্কুলের পাশের বন্ধুর ব্যাগ থেকে কোন কিছু নেয়ার আগেও সে যেন অনুমতি নিয়েই করে।
হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা
মানুষের হাঁচি-কাশি যেকোন সময় যেখানে সেখানে আসতে পারে। এক্ষেত্রে কোথাও হুট করে কাশি চলে আসলে হাত কিংবা সাথে টিস্যু থাকলে তা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখাও ভদ্রতা। হাঁচি-কাশির সময় মুখ না ঢাকলে মুখের থুথু সামনে থাকা কারোর গায়ে পড়তে পারে। বিষয়টি তার জন্য ও তার সামনের মানুষের জন্য কতটা বিব্রতকর তা আপনার সন্তানকে বোঝাতে পারেন।
বড়দেরকে তুই করে সম্বোধন না করা
অনেক ছোট বাচ্চার মাঝে এই প্রবণতাটি দেখা যায়। তারা বড়দের তুই করে সম্বোধন করে। এতে তাদের দোষ খুব একটা নেই। তারা আসলে সম্বোধনের সাথে পরিচিতই না। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বাসার বড়রা ছোটদের তুই করে ডাকা শুনলে অনেকক্ষেত্রে শিশুরা তা শিখে ফেলে। আপনার সন্তানের মাঝে এমন কিছু লক্ষ্য করলে তাকে সম্বোধনের বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন। কাকে তুই বলবে, কাকে তুমি, কাকে আপনি ইত্যাদি বিষয়গুলো কয়েকবার বোঝালে শিশুরা বুঝতে পারবে। বড়দের সাথে অসম্মানসূচক কোন কাজ করলেও তাকে সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে বলুন।
কাউকে বুলিং না করা
খেয়াল রাখুন, আপনার সন্তান যেন বুলিংকারী না হয়। কারো নাম ব্যঙ্গ করা, শারীরিক গড়নের জন্য কাউকে নিয়ে মজা করা, স্কুলে পড়ালেখায় দুর্বল ছাত্রটিকে নিয়ে মজা করা; এমন আরো যেসব বুলিং রয়েছে সেসব নিয়ে সন্তানের সাথে কথা বলুন। এতে বুলিং-এর শিকার মানুষটি কতটা কষ্ট পায় তা সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন। কাউকে বুলিং না করার শিক্ষাতো সন্তানকে দিবেনই; পাশাপাশি সন্তানের মাঝে কাউকে বুলিং করার প্রবণতা দেখলে অবশ্যই সন্তানকে সচেতন করবেন।
কাউকে সাহায্য করা
মানুষকে সাহায্য করতে পারা একটি অসাধারণ গুণ। প্রশ্ন জাগতে পারে, শিশুরা কীভাবে সাহায্য করবে! ওরা নিজেরাই তো অন্যের সাহায্য নেয়। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, শিশুরা নানাভাবে কিন্তু তার আশেপাশের মানুষদের সাহায্য করতে পারে। একটু বড় হলে ঘরে আপনাকেই রান্নার কাছে সাহায্য করার মতো ছোট একটি কাজ কিন্তু সে করতে পারে। একই সাথে বাসায় দাদা-দাদু থাকলে তাদেরকে প্রয়োজনীয় কিছু এগিয়ে দিতে পারে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় পাশের বাসার আন্টির হালকা কোন বাজারের ব্যাগ বহন করেও সে সাহায্য করতে পারে।
লক্ষী অতিথি
সাধারণত শিশুরা একটু অস্থির, চটপটে হয়ে যাবে। অনেকে কোথাও বেড়াতে গেলেও দুষ্টুমি করে। একটু বড় হলে সন্তানকে কোথাও বেড়াতে গেলে সাধারণত ভদ্রতার বিষয়গুলো শেখাতে পারেন। দুষ্টুমি শিশুরা করবেই। এটা দোষেরও কিছু না। কিন্তু আপনি তাকে শেখাতে পারেন তার দুষ্টুমি যেন কারোর ক্ষতির কারণ না হয়। কারো বাসায় বেড়াতে গেলে সেখানকার এটে-সেটা অনুমতি ছাড়াই নিয়ে নেয়া কিংবা দুষ্টুমি করতে গিয়ে সেখানকার কোন জিনিস নষ্ট করার মতো বিষয় যেন তার দ্বারা না ঘটে। একই সাথে নিজেদের বাসায় কেউ বেড়াতে আসলে তার আচরণ কেমন হওয়া উচিত তাও আপনি সন্তানকে শেখাতে পারেন।
শেয়ার করতে শেখা
শেয়ার করার অসাধারণ গুণটি মানুষের সাথে সম্পর্ক যেমন সুন্দর করে তেমনি মানসিক প্রশান্তিও বাড়ায়। আপনি সন্তানকে ছোট থেকেই শেয়ারিং শেখাতে পারেন। নিজের ভাই-বোন বা কাজিনদের সাথে নিজের খেলনা শেয়ার করা, মাঝে মাঝে একজন দুস্থ মানুষকে সাহায্য করা কিংবা বাসায় এনে তার সাথে খাবার শেয়ার করার মাধ্যমে ছোট থেকেই সন্তানের মাঝে এই অসাধারণ গুণটি গড়ে তুলতে পারেন।
সৎ থাকা, সত্য কথা বলা
ছোট থেকেই শিশুরা সততার বিষয়টি তাত্বিক মূল্য হয়তো ওত ভালোভাবে বুঝবে না। তবে আপনি তাকে ছোট থেকেই যদি সত্য কথা বলার ব্যাপারে সচেতন করতে পারেন, তাহলে বড় হতে হতে সে দারুণ একজন সৎ মানুষ হতে পারবে। সত্য কথা বলার মূল্য তাকে বোঝাতে পারেন। কোন ক্ষেত্রে নিজের ভুল হলেও যেন তা লুকানোর চেষ্টা না করে সত্য কথাটি বলে। বাসায় তার একটা বিশ্বাস্ত ব্যক্তি ঠিক করতে পারেন। বাবা কিংবা মা, কিংবা দু-জনের কাছেই যেন সত্য কথা কোন দ্বিধা, ভয় ছাড়াই বলে দিতে পারে। সত্য বলা ও সৎ থাকার নৈতিক, ধার্মিক ও সামাজিক মর্যাদার কথাও সন্তানকে বলতে পারেন।
বাজে শব্দ ব্যবহার না করা
আপনি একটা ভালো শব্দ সারাদিন বলেন, শিশু সেটা শিখতে একটু সময় নিবে। কিন্তু একটা বাজে শব্দ বলেন, সাথে সাথে সে তা রিপিট করবে। খারাপ শব্দ হোক কিংবা ভালো শব্দ সন্তান তা তার চারপাশ থেকেই শিখবে। সেক্ষেত্রে তার সামনে খারাপ শব্দগুলো ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করুন। ভালো ভালো শব্দ বেশি বেশি করে বলুন। আর কোনভাবে যদি কোন খারাপ শব্দ সে শিখে ফেলে, আপনি যদি তা বুঝতে পারেন, তাহলে তার মুখ থেকে তা নিঃসৃত হওয়ার সাথে সাথে তাকে বুঝিয়ে বলুন। একই সাথে কেন খারাপ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, কেন ভালো শব্দ ব্যবহার করা ভালো মানুষের পরিচয় বহন করে; ইত্যাদি বিষয় গুলো নিয়ে তার সাথে কথা বলুন।
পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া
আপনার সন্তানকে নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি যত্নশীলও হতে শেখাবেন। শেখাবেন আমরা সবাইই পরিবেশেরই অংশ। পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানেই নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া। তার দ্বারা যেন পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয় তা শেখান। আমাদের চারপাশের গাছ, ফুল, পাখি সব রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। শুরু করতে পারেন যেখান সেখানে ময়লা বা থুথু না ফেলার অভ্যাস তৈরি করার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
2,714 total views, 1 views today