হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসা পাখিগুলো শীত সম্পর্কে জানান দিচ্ছে আপনাকে। মনে মনে সাজিয়ে ফেলছেন শীতে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন। রাফিনও এমন একটা পরিকল্পনা করে রেখেছে এবার শীতে সে সুন্দরবন ঘুরতে যাবে। বাবার অফিসের ছুটিও সেভাবে নেওয়ার জন্য আগে থেকেই বলে রেখেছে। এর মধ্যে রাফিনের দু-একজন বন্ধুও তাদের সাথে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। দুঃখের বিষয় দু’দিন বাদেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল যখন কিনা রাফিনের ছোট ভাই ঠাণ্ডাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ল। শীতকালে আমরা প্রায় ঠাণ্ডাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ি। যার প্রভাব আমাদের স্বাস্থের উপর পড়ে, ভেস্তে যায় সব পরিকল্পনা।
শীতকালে ঠান্ডা তাপমাত্রা ও যে সব সংক্রমণ আপনাকে অসুস্থ করে তোলে সে সম্পর্কে জানা থাকলে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হতে পারে ঐ সমস্ত রোগ থেকে । চলুন আমরা খুজে বের করি সে সমস্ত ঠান্ডাজনিত রোগগুলো, জেনে নেয় সে সম্পর্কে।
সাইনোসাইটিস
মানুষের মুখমণ্ডল তথা মাথার খুলির চারপাশে চার জোড়া বায়ুকুঠরি আছে, যাকে সাইনাস বলে। এসব বায়ু কুঠরি বা সাইনাসে ঘা বা প্রদাহ হলে তাকে সাইনোসাইটিস বলে।
এ রোগে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নাক থেকে হালকা তরল পদার্থ বের হতে পারে। মনে হতে পারে ঠান্ডা লেগেছে। হ্যাঁ এটি ঠন্ডা হতে পারে আবার নাও পারে। হতে পারে সাইনোসাইটিস! তবে এটি যে সাইনাস ইনফেকশন না তা কিন্তু একবাক্যে বলা যাচ্ছে না। দাঁত বা নাকের ইনফেকশন থেকে, অঘাতের কারণে সাইনাস ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা থেকে হতে পারে সাইনোসাইটিস। দূষিত বা স্যাতস্যাতে পরিবেশে এ রোগের প্রাদূভার্ব
উপসর্গ
মাথাবাথা এ রোগের অন্যতম কারণ। সাইনাসের ধরণ অনুযায়ী মুখ ও মুখমণ্ডলের বিভিন্ন স্থানে এ ব্যথা হতে পারে। কপালে, মাথার পিছন দিকে ব্যথা থাকতে পারে। জ্বরেরে সাথে কখনো আবার নাকের গোড়া, চোখের নীচে ফুলে যেতে পারে, ব্যথা হতে পারে শরীরে। নাকের ভিতরে হাড় বাকা বা মাংস ফুলে গেলে সাইনোসাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাইনোসাইটিস হলে চোখ ও মস্তিষ্কের বিভিন্ন জটিল রোগ হতে পারে। চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মেনিনজাইটিস এমনকি ব্রেইন এবসেসের মত মারাত্নক রোগ সাইনাস ইনফেকশনের কারণে হতে পারে।
প্রতিরোধ
ঠাণ্ডা ও অ্যালার্জির কারণে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। তাই আপনার উচিত এগুলো থেকে দূরে থাকা। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে আজ থেকেই ছাড়তে চেষ্টা করুন। দূষিত পরিবেশে এ রোগের অন্যতম কারণ। আপনার পরিবার নিয়ে যথাসম্ভব স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করুন। ঘুমানোর সময় মাথা উচু করে ঘুমানোর অভ্যাস করুন।
প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
সর্দি
বিরক্তিকর এক অসুখের নাম সর্দি। জীবনে সর্দি হয়নি এমন মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া ভার। সার বছরই এ রোগ হতে পারে তবে শীতকাল আসলে এ রোগের প্রকোপ আরও বেড়ে যায়। শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। বয়স্ক মানুষ বছরে ২-৩ বার আর শিশুরা বছরে ৬ থেকে ১২ বার সর্দির ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সর্দি থেকে বাচ্চাদের নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
রোগের কারণ
বিভিন্ন ধরণের ভাইরাসের সংক্রমণে এরোগ হয়। প্রায় ২০০ প্রকার ভাইরাসের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘রাইনো ভাইরাস’ এ জন্য দায়ী। অন্যান্য ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে কোরোনা ভাইরাস, রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল, প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রভৃতি।
সর্দির ভাইরাস কণিকাগুলি দূষিত বাতাস বা, দূষিত আঙ্গুলের মাধ্যমে আমাদের নাকের ভেতর জমা হয়। মাত্র কিছু ভাইরাস কণিকাই (১-৩০) সংক্রমণের জন্যই যথেষ্ট। ভাইরাস কণিকাগুলো নিজে নিজেই নাকের adenoid নামক স্থানে প্রবেশ করে। এরপর কণিকাগুলো অনুনাসিক কোষ পৃষ্ঠের উপর অবস্থিত রিসেপ্টর (ICAM 1) এর সাথে যুক্ত হয়। এই রিসেপ্টর ভাইরাস পৃষ্ঠের উপর ডকিং পোর্ট নামক অংশের সাথে মিশে যায়। এ পর্যায়ে ভাইরাস একটি কোষের মধ্যে সংক্রমিত হতে শুরু করে। এরপর সংক্রমিত কোষে ভাইরাস তার সংখ্যাবৃদ্ধি করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সংক্রমিত কোষের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে ভাইরাস কণিকা নতুন নতুন কোষে সংক্রমিত হয় এবং তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে , যার ফলে আমরা সর্দিতে আক্রান্ত হই।
এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে, ব্যবহার্য্য জিনিস পত্রের মাধ্যমে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়।
আরো পড়তে পারেন- শিশুর শীতকালীন অসুখ, জেনে নিন ৫টি ঘরোয়া টিপস
লক্ষণ
লক্ষণ হিসাবে শরীর ম্যাচ ম্যাচ করবে, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে পানি ঝরা, গলাব্যাথা, ঘন ঘন কাশি, হালকা জ্বর জ্বর থাকতে পারে। এছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে মাথা ব্যাথা, খাবারে অরুচি, মাংশপেশীতে ব্যাথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
সাধারণত সর্দি ৭ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হতে পারে। তবে ক্ষেত্র বিশেষ তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় থাকতে পারে।
রক্ষা পাওয়ার উপায়
কিছু সর্তকতা অবলম্বন করলে সর্দির মত বিরক্তিকর রোগ থেকে আমরা সহজেই রক্ষা পেতে পারি।
১। সর্দিতে অক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি- কাশি থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরে থাকুন। কেননা হাঁচি-কাশির সময় এ রোগের জীবাণু বাইরে বের হয়ে আসে এবং খুব সহজে তা চোখ বা নাকের ভিতর দিয়ে মানুষের শরিরে প্রবেশ করে।
২। পর্যাপ্ত পানি পান করুন, কমপক্ষে দৈনিক ৮ গ্লাস। পানি দেহ থেকে জীবানু নির্গমনে সাহায্য করে।
৩। আঙ্গুল দিয়ে ঘন ঘন নাক, চোখ চুল্কাবেন না।
৪। হাত সবসময় পরিষ্কার রাখুন। হাঁচি-কাশির জীবানু হাতে লেগে স্পর্শের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
৫। সর্তকতার জন্য মাস্ক ব্যবহার করে যেতে পারে।
৬।পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া।
সাধারণত সপ্তাহখানেকের মধ্যে এ রোগ থেকে মুক্তি মিলে। কিন্তু তার থেকে বেশি স্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ইনফ্লুয়েঞ্জা
ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত ‘ফ্লু’ হিসাবে পরিচিত। ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি ভাইরাস জনিত রোগ। শীতকাল আসলেই এ রোগ বেশি হতে দেখা যায়।
লক্ষণ
সর্দিকাশি, জ্বর ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাথমিক কারণ হতে পারে। মাথাব্যাথার সাথে জ্বর বাড়তে পারে এ রোগে। থাকতে পারে গলা ব্যাথা ও পেশি ব্যাথা। এমন লক্ষণ ৩-৫ দিনের বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। অনেকে এটাকে গুরুত্ব দেয় না ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ধীরে ধীরে নিউমোনিয়ায় রূপান্তর হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে শীতকালে একটু বেশি সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।
প্রতিরোধ
ইনফ্লুয়েঞ্জার হাত থেকে বাঁচতে কিছু সর্তকতা অবলম্বন করা যেতে পারে। ধূলাবালি থেকে দূরা থাকার চেষ্টা করা, হাচিঁ কাশির সময় রুমাল ব্যবহার করা। খাবারের পূর্বে অবশ্যই ভালোভাবে হাত ধোঁয়া। ঠান্ডা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।
আক্রান্ত ব্যাক্তিকে বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খেতে দিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে।
নিউমোনিয়া
নিউমোনিয়া সংক্রমনে ফুসফুসের প্রদাহ ঘটে। নিউমোনিয়া একটি সংক্রামক রোগ। শীতকালে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনে এ রোগের প্রকোপ বাড়ে। হৃদরোগ, ক্যানসার, হাঁপানির মত দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও বাচ্চাদের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নিউমোনিয়ায় অক্রান্ত ৫ বছরের কম বয়সী শিশু শতকরা ২২জন মারা যায়।
লক্ষণ
জ্বর ও কাশি এরোগের প্রধান লক্ষণ। রোগীর শরীর বেশ দূর্বল হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ করে বয়ষ্করা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। লক্ষণ হিসাবে এরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট হতে পারে। হতে পারে ডায়রিয়া। আক্রান্তের কোন একপর্যায়ে বমি বমি ভাব, ক্ষুদামন্দা দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধ
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিষেধক মূলক ভ্যাকসিন নিতে হবে। যথাসম্ভব ঠাণ্ডা থেকে দূরে থাকা। হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা মাস্ক ব্যবহার করা কেননা এরোগের জীবাণু আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশি মাধ্যমে ছড়ায়। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। খাবারের পূর্বে অবশ্যই হাত পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,763 total views, 1 views today