বাবা-মা সন্তানের জীবনের প্রথম ও সব থেকে বড় শিক্ষক। সন্তানকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাবা মা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। একবিংশ শতাব্দির এই যুগে এসে বাবা-মা দুজনই যখন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার করছেন তখন অভিভাবক ও সন্তানের সম্পর্কে নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুই প্রভাবই পড়তে পারে। কর্মজীবী পিতামাতা হিসেবে আপনার ক্ষেত্রে কোনটা ঘটেছে?

কাজ কিভাবে সন্তান ও বাবা-মার সম্পর্ককে প্রভাবিত করে?
পূর্বে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ছিল, যেখানে শিশুদের দেখাশোনার জন্য বাবা-মায়ের পাশাপাশি আরও অনেকে ছিল। যেমন- খালা, ফুফু, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি, নানা-নানি আরও অনেকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে একক পরিবারের সংখ্যা দিনকে দিন হু হু করে বেড়ে চলেছে। কর্মজীবী বাবা-মা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় তার আদরের সন্তানকে রেখে যাওয়ার জন্য এমন কেউকে পাচ্ছে না যে সন্তানের দেখাশুনা করতে পারে পরম যত্নে। ফলে সন্তান থাকছে একাকী। হয়ে উঠছে একঘেয়ে কিংবা পা বাড়াচ্ছে কোন ভুল পথে। সন্তানের এই একাকীত্বের ভাল ও মন্দ দুই দিকই আছে।

পিতামাতার উভয়ের কাজ তাদের সন্তানের জীবনে অনেক সময় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে আবার অনেক সময় কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তার মধ্যে কিছু নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরা হল-

মানসিক প্রভাব
কাজের সুবাদে বাবা-মাকে প্রায়ই শহরে যাতায়াত করতে হয়। একক পরিবারের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে দেখাশোনার কেউ থাকে না। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে বেবিসিটার বা ডে-কেয়ারের সুযোগ ততটা না থাকায় বাবা-মাকে বাধ্য হয়ে অদক্ষ গৃহকর্মীর কাছে সন্তান রেখে যেতে হয়। আর দু’একজন সাথে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে গেলেও দেখা যায় মাদুর পেতে তার চেয়ারের কাছে ফেলে রেখেছে বাচ্চাকে, কাজের চাপে ঠিকমত খাওয়ানোর সময় পাচ্ছে না, পারছে না সঠিক পরিচর্যা করতে। ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকলেও বাচ্চার সাথে একান্ত সময় দিতে পারছেন না শিশুর এমন বেড়ে ওঠা তার মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। আপনার শিশুর বেড়ে উঠায় ঠিক মত খেয়াল রাখছেন তো?

আচরণগত পরিবর্তন
বাচ্চারা যখন ডেকেয়ার বা বেবিসিটারের কাছে থাকে অথবা তাদের কাছ থেকে চলে এসে একাকী থাকে তখন তারা অস্থিরতায় ভুগে, তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়। বাবা-মা যেহেতু সন্তানকে সময় দিতে পারে না, তাদের এমন আচরণ আস্তে আস্তে আরও রূঢ় ও আক্রমণাত্নক হয়।

যেতে পারে খারাপ পথে
একাকীত্বতা ঘোচাতে সে আশেপাশের অপরিচিত বাচ্চাদের সাথে মিশতে শুরু করতে পারে। বাচ্চাদের সাথে মেলামেশার সময় পরিচয় হতে পারে কিছু খারাপ মানুষের সাথে, যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আপনার সন্তান পা বাড়াতে পারে খারাপ পথে। নেশা থেকে শুরু করে যেকোন খারাপ কাজে জড়িয়ে যেতে পারে আপনার সন্তান। খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার সন্তান এমন কিছুতে আসক্ত নাতো?

মাতাপিতার সাথে দূরত্ব
প্রতিযোগিতার এই বাজারে এমনিতেই কর্মজীবীরা ছুটি পায়না, যাও দু’একদিন পায় বাড়ির কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার অনেককে ছুটির দিনেও অফিসের কাজ করতে হয়। বাচ্চাদের একেবারে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। হয়ে ওঠে না সন্তানের সাথে একান্ত গল্প করা, ঘুরতে যাওয়া। দিনকে দিন সন্তান বড় হতে থাকে আর বাবা-মার সাথে তাদের দূরত্ব বাড়তে।

কোন বাবা-মা’ই চাই না তার সন্তান ভিন্ন পথে যাক। এমন নেতিবাচক কথাবার্তা আপনাকে কিছুটা ঘাবড়ে দিলেও এবার আমরা এমন কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করছি যা কর্মজীবী বাবা-মা হিসাবে আপনার এবং আপনার সন্তানের বোঝাপড়ার জন্য ইতিবাচক হতে পারে।

আরো পড়তে পারেন- সন্তানকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পড়াতে ৫টি কৌশল

উন্নত জীবনযাপন
যে সব পরিবারের বাবা ও মা উভয় চাকুরি করে তারা ও তাদের সন্তানেরা উন্নত জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাবা ও মা উভয়ে চাকুরি করায় আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকে, ফলে তারা তাদের সন্তানের জীবনমানে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন কি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও বেশি ব্যয় করতে পারে। যা সন্তানের ভাল ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। পাল্টে দিতে পারে তার জীবন চলার পথ।

জীবনের অভিজ্ঞতা
আপনি নিশ্চয় কর্মক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রের বাইরে বিভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। এগুলো নিয়ে সন্তানের সাথে আলোচনা করুন। জীবন সম্পর্কে তাদের জানাতে পারেন। তারা যখন এগুলো জানবে তখন তাদের জীবন সম্পর্কে উপলব্ধি হবে। তারা সঠিক ও পরিপক্ক দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হবে।

সময়ের মূল্য
বাবা-মা উভয়কে যেহেতু কর্মক্ষেত্রে যেতে হয় ফলে তারা বাচ্চাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য খুবই কম সময় পায়। এমন পরিস্থিতিতে আপনি বাচ্চাদের শেখাতে পা্রেন সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে এবং বুঝাতে পারেন সময় একবার চলে গেলে তা আর ফিরে আসে না। এরকম পরিবেশে বাচ্চারা খুবই দ্রুত সময়ের মূল্য সম্পর্কে বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে।

স্বাধীন ও আত্নবিশ্বাসী
কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তানেরা খুব দ্রুত নিজেকে স্বাধীন হিসাবে গড়ে তোলে। কেননা তারা জানে বাবা-মা ব্যস্ত থাকায় তাদের বিভিন্ন বিষয় নিজেকে সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে কোন কাজে স্বাধীনভাবে ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার এমন প্রবণতা আপনার সন্তানকে আত্নবিশ্বাসী করে তুলবে।

চাপ মোকাবেলা
বাচ্চারা যখন খেয়াল করে যে কিভাবে বাবা-মা তাদের পারিবারিক ও কর্মজীবনের ভারসাম্য রক্ষা করছে, তখন বাবা-মা ও অন্যদের প্রতি তাদের সম্মান আরো বেড়ে যায় এবং পরবর্তী জীবনে তারা দক্ষতার সাথে চাপ মোকাবেলা করে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে পারদর্শী হয়।

প্রতিটি শিশু যেমন অনন্য ঠিক তেমনি তাদের সন্তান লালন পালনের ধরণও অনন্য। দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে সবকিছুর ঊর্ধ্বগতি এই বাজারে যেমন কাজ ছেড়ে দেওয়ার উপায় নাই ঠিক তেমনি আমরা চাই  সঠিকভাবে বেড়ে উঠুক আপনার আদরের ছোট্ট সোনামনিটি। কর্মজীবী বাব-মায়েরা তাদের সন্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন নতুন পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারেন। তার কয়েকটি আমরা তুলে ধরলাম আপনার জন্য।

সময়ের ভারসাম্য রক্ষা
৮টা থেকে ১০ ঘন্টা কাজ শেষে জ্যাম ঠেলে বাসায় ফিরে সন্তানের সাথে একান্ত সময় কাটানোর ইচ্ছা ও শক্তি কোনোটাই থাকে না। এটা চরম সত্য যে বাবা মা তাদের আয় বাড়াতে চাকুরির দিকে ঝোঁকে, তারা চাই তাদের সন্তানের জীবনমানের উন্নয়ন হোক। সন্তানের জীবন মানের উন্নয়নে বা ঘরের অসুস্থ শিশুটির সেবাযত্নের জন্য অফিসের সময়ের সাথে আপনার সময়ের সামঞ্জস্য করে নিন। প্রতিদিনের রুটিনে একটা নির্দিষ্ট সময় রাখুন শুধুমাত্র আপনার সন্তানের জন্য। আপনি কি এমন কোন নির্দিষ্ট সময় রাখেন আপনার সন্তানের জন্য? কমেন্টে জানিয়ে দিন আমাদের, কোন সময়টা আপনার সন্তানের জন্য রেখেছেন?

সহায়তা নিন দাদা দাদী বা নানা-নানীর
খেয়াল করে দেখেন ছোটবেলায় আপনি দাদ দাদীর পিছু ছাড়তেন না, সুযোগ পেলেই রাতে ঘুমিয়ে যেতেন দাদীর ঘরে, গল্প শুনতেন রাক্ষস বুড়ির। বাবা-মার কাছ থেকে যেমন শিখেছেন, শিখেছেন দাদা-দাদীর কাছ থেকেও। আপনার অনুপস্থিতিতে দাদা দাদীই হতে পারে আপনার সন্তানের বিশ্বস্ত খেলার সাথী। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কাছে সন্তানকে রেখে যেতে পারেন নিশ্চিন্তে। বাবা-মা আপনাকে যেমন আদর্শে বড় করেছেন, ঠিক তেমনি আপনার বাবা-মা আপনার সন্তানকে সঠিক অদর্শে বড় করবেন যা আপনার সন্তানের সঠিক বেড়ে উঠা ও মানসিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার সন্তানের মেধা বিকাশে সহায়ক হতে পারে অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স

ডে-কেয়ার/চাইল্ড কেয়ার
দাদা দাদি বা বেবিসিটারের সহায়তা পাচ্ছেন না তাহলে আপনার বাচ্চাকে ডে-কেয়ার বা চাইল্ড কেয়ারে ভর্তি করতে পারেন। আপনারা দু’জনে যখন অফিসে ব্যস্ত সময় পার করছেন আপনার সন্তান তখন ডে-কেয়ারে খেলছে মজার খেলা, পড়ছে কোন মজার গল্প। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতা আপনার সন্তানকে গড়ে তুলবে চৌকস হিসাবে।

অভ্যস্ত করে তুলুন শখের কাজে
এটা হতে পাতে আপনার সন্তানের জন্য দারুণ একটা কিছু যা তাকে চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে সহায্য করবে। শখের কাজগুলো তাকে শারীরিক ও সৃজনশীল কাজে আরও বেশি দক্ষ করে তুলবে। এমন কাজে অভ্যস্ত বাচ্চার চিন্তাতে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবেন।

প্রতিটি অভিভাবকই চাই তার সন্তান সমাজের সকল ভাল কাজে অংশগ্রহন করুক, বড় হোক সফলতায়। একজন সচেতন অভিভাবকই পারে সন্তানের সঠিক বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। কর্মজীবী বাব-মা ও তার সন্তানের সম্পর্ক হোক অনন্দে ভরপুর।

আপনি কিভাবে মোকাবেলা করছেন কর্মক্ষেত্র ও প্যারেন্টিং শেয়ার করুন আমাদের সাথে।

বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।

 

 1,473 total views,  1 views today

What People Are Saying

Facebook Comment