লিফট ছিঁড়ে যাওয়া দুর্ঘটনায় লাফালে কী বাঁচা যাবে?
মনে করো, তুমি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ভবন সিটি সেন্টারের ৩৫ তলা থেকে লিফটে নিচে নামবে! লিফটে ওঠার পর ৩৪ কিংবা ৩৩ তলায় এসে বুঝতে পারলে লিফটির তার ছিঁড়ে গেছে। মানে, এখন লিফটটি তোমাকে নিয়ে একদম মুক্তভাবে নিচের দিকে পড়ছে। এমন অবস্থায় কী করবে? ভাববে? কাউকে ফোন দিবে? সাহায্য চাইবে? ইমার্জেন্সি বাটনে চাপ দিবে? আসলে তখন এইসব কোন কিছুই ভাবার টাইম পাবে না যদি না আগে থেকে তুমি কিছু ধারণা নিয়ে না রাখো। কারণ লিফটের ছয়টি কেবলের একটা ছিঁড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অকেজো হয়ে যায় অন্যসব কেবল। আর প্রতি সেকেন্ডে লিফটের পতিত হওয়ার গতি বাড়তে থাকে। চার সেকেন্ড পরেই লিফটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪০ মিটার গতিতে নিচের দিকে পড়তে থাকবে। যা ঘন্টায় প্রায় ৯০ মাইলের সমান। আর এই গতিতে লিফটি সিটি সেন্টারের ৩৫ তলা থেকে নিচে পড়তে সময় নিবে মাত্র ৬ সেকেন্ড! মাত্র ৬ সেকেন্ডে তুমি কী করবে? ভাবা বা সাহায্য চাওয়াতো দূরের কথা এই ছয় সেকেন্ডে তুমি ঠিকমত আতঙ্কিত হওয়ার টাইমই পাবে না! কিন্তু ছয় সেকেন্ডে তুমি শান্ত থেকে মস্তিষ্কের ব্যবহার কিন্তু করতে পারবে।
লিফট ছিঁড়ে যাওয়া দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকেই ধারণা করে লিফটের ভিতর লাফালে বাঁচা যাবে কিংবা সোজা দাঁড়িয়ে থাকলে বাঁচা যাবে। আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটু বোঝার চেষ্টা করবো আসলে বাঁচা যাবে কী না? তাহলে চলো জেনে নিই, লাফালে বা দাঁড়িয়ে থাকলে কী হবে এই ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে।
দাঁড়িয়ে থাকলে কী হবে?
লিফট ছিঁড়ে পড়তে লাগলো, ধরো কেউ একজন দাঁড়িয়ে থাকলো। এক্ষেত্রে যখন লিফটটি তাকে নিয়ে নিচে পড়বে ঠিক তখন তার ওজন তার স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যাবে। কীভাবে সেটা? ধরো, তার ওজন ৪০ কেজি আর লিফটটি তাকে নিয়ে নিচে পড়ছে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ মিটার গতিতে। তাহলে তার ভরবেগ দাঁড়ালো ৪০x৪০=১৬০০ কেজি/মিটার প্রতি সেকেন্ডে। আর যেহেতু তার ও লিফটের উপর অভিকর্ষজ ত্বরণও কাজ করছে সেহেতু প্রতি সেকেন্ডে তার ভরবেগ বাড়তে থাকবে। আর ঠিক এই ভরবেগ নিয়ে যখন সে নিচে পড়বে, দাঁড়িয়ে থাকার ফলে তখন তার শরীরের কয়েক গুণ বাড়তি ভার লম্বালম্বিভাবে অল্প কয়েকটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হবে। তখন তার মনে হবে তার ওজনের অনেক গুন বেশি ওজনের কিছু দিয়ে অনেক গতিতে কেউ তার মাথায় আঘাত করছে। ফলে মাথার ভারে আগে ভাঙবে ঘাড় এরপর ধীরে ধীরে সব ধুমড়ে মুচড়ে যাবে। মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
(আরো পড়তে পারো- পৃথিবী গোল নাকি সমতল! )
লাফালে কী হবে?
প্রথমত জেনে নাও লাফালে বাঁচার ব্যাপারে ভুল ধারণাটা কী? সবাই ভাবে লাফিয়ে যখন নিজেকে লিফটের ভেতর শূন্য অবস্থায় বা মুক্ত অবস্থায় রাখা যাবে তাহলে লিফটটি আগে পড়বে আর পরে সে পড়লে তেমন ব্যাথা পাবে না। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, কেউ যখন লিফট থেকে শূন্যে লাফাবে তখন কিন্তু লিফটটা লাফাবে না, লিফট একই গতিতে পড়তে থাকবে। একই গতিতে পড়তে থাকলে সে লিফটের উপরের অংশের সাথে প্রথমে ভয়াবহ আঘাত পাবে মাথায়। এরপর তাকে আবার লিফটের মেঝেতেই ফিরে আসা লাগবে। লিফটের মেঝেতে যখন সে ফিরে আসবে তখন তার ভরবেগ বেড়ে তার শরীরের ওজনও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। লাফানোর আরো একটা সমস্যা আছে। ছোটবেলায় দীর্ঘলাফ কিংবা উচ্চলাফ খেলে থাকলে তুমি এই বিষয়টা বুঝতে পারবে। লাফ দেয়ার জন্য মাটিতে কিছু বল প্রয়োগ করতে হয়, যত বেশি বল প্রয়োগ করা যায় আমরা তত বেশি উপরে উঠি। সেক্ষেত্রে লিফটে লাফ দেয়ার জন্য লিফটের মেঝেতে একটা বল প্রয়োগ করতে হয়, এই বলের পরিমাণ কমপক্ষে ৪৬০ নিউটন বা ৪৬ কেজির মতো। মজার বিষয় হলো লাফ দেয়ার জন্য মেঝেতে এই বল প্রয়োগ করার ফলে লিফটের ওজন আরো ৪৬ কেজি বেড়ে যায় ফলে লিফট আরো দ্রুতগতিতে নিচে পড়তে থাকে। ফলে ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে।
তাহলে কী করতে হবে?
লিফটে দাঁড়িয়ে থাকলেও ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে, লাফ দিলেও বেড়ে যাবে! তাহলে কী করতে হবে? এই প্রশ্ন ঘুরছে তো মাথায়? এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল সেন্টারের গবেষক ইলিয়ট এইচ ফ্রাঙ্ক এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, লিফটে এমন দুর্ঘটনায় সময় মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকাই অন্যগুলোর চেয়ে নিরাপদ পন্থা। তোমার মনে হচ্ছে, চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেও তো একই ভরবেগ থাকবে, ওজনও বেড়ে অনেক গুণ হয়ে যাবে। তাহলে নিরাপদ পন্থা কীভাবে হলো। কিন্তু ইলিয়টের একটা দারুন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। যখন কেউ চি ৎ হয়ে শুয়ে পড়বে তখন ভরবেগ বা বাড়তি ওজন পুরোটা শরীরের বিভিন্ন বিন্দুতে ছড়িয়ে পড়ার ফলে সব ওজন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পড়বে না। বরং আঘাতটা শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে ফলে আঘাতের তীব্রতা কমে যাবে। যেটা দাঁড়িয়ে থাকলে বা লাফ দিলে হবে না।
তাহলে বন্ধুরা তোমরা তো জানলে লিফটের তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনায় পড়লে কী করতে হবে! তাহলে এবার বাসার বড়দেরকেও এই বিষয়টা জানিয়ে অবাক করে দাও। সাথে আরেকটা কথা জানিয়ে দিবে, বিশ্বে লিফট দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ০.০০০০০০১৫%। যুক্তরাষ্ট্র ১৮০০ কোটি বার লিফট ওঠানামার মধ্যে যে কয়টি দুর্ঘটনা হয় তার মধ্যে মাত্র ১৭ জন মারা যায় প্রতি বছরে।
পরবর্তী পর্বগুলি পড়তে আমাদের সাথেই থাকো।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
2,037 total views, 1 views today