আমি তখন কলেজে উঠেছি। বাসা থেকে একটি সাইকেলও কিনে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত খরচের জন্য প্রতিদিন কিছু টাকাও দেয়া হতো বাসা থেকে। তখন আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন “তোমার সামনে এখন বিশাল একটি স্বাধীন পথ। এই পথে নিজের দায়িত্ব নিতে হবে। নিজেকেই নিতে হবে অনেক সিদ্ধান্ত। নিজেকে নিয়ন্ত্রণও করতে হবে নিজেই”। হাইস্কুল শেষে যখন আপনার সন্তান কলেজে ওঠে তখন তার সামনে আসলেই একটি স্বাধীন পথ তৈরি হয়। দিনের বেশিরভাগ সময় থাকে আপনার নজরের বাইরে। অনেক স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে হয় নিজেকেই। আর যারা পড়ালেখার জন্য হাইস্কুলের পরই পরিবার থেকে দূরে থাকে তখন তাদের প্রায় সব দায়িত্ব নিতে হয় নিজেকেই। এই সময়টার সাথে ভালোভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে ও সাফল্য পেতে আপনার সন্তানের কিছু লাইফ স্কিল জানা থাকা অত্যন্ত জরুরী। আজকের ব্লগে আমরা টিনেজারদের কলেজে ওঠার আগেই যেসব লাইফ স্কিল জানা জরুরী সে সব নিয়েই আলোচনা করবো।
বাজেটের সঠিক ব্যবহার
কলেজে ওঠা বা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে ঘর ছাড়ার সাথে সাথে আপনার সন্তান পরিচিত হবে ব্যক্তিগত বাজেটের সাথে। সেটা হোক মাসিক খরচ কিংবা সাপ্তাহিক খরচ কিংবা দিনের। নিজে টুকটাক রোজগার করুক কিংবা বাসা থেকেই নিক না কেন, এই সময়ে একটি নির্দিষ্ট বাজেটে থেকেই তাকে মাস, দিন, সপ্তাহ পার করতে হবে। জানতে হবে বাজেট ব্যয়ের সঠিক পন্থাও। তার বাজেটের সাপেক্ষে কোন খরচটা প্রয়োজনীয়, কোনটা অপ্রয়োজনীয় তা সম্পর্কে সন্তানকে একটি স্পষ্ট ধারণা দিয়ে রাখা ভালো। চাইলে নিজের খরচের রেকর্ডও রাখতে পারে। এক্ষেত্রে সন্তানকে কলেজে ওঠার আগেই টুকটাক টাকার হিসেব রাখার বিষয়ে সচেতন করতে পারেন। খরচের জন্য টাকা দিলে মাঝে মাঝে সেই টাকার খরচের খাতও জানতে চাইতে পারেন। এতে আপনি তার খরচের খাত সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন ও একই সাথে তাকে সঠিক খাত সম্পর্কে ধারণাও দিতে পারবেন।
সময়ের সঠিক ব্যবহার
এতদিন হয়তো খাওয়ার সময় তাকে আপনিই খেতে ডেকেছেন। ক্লাসের আগে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। সকালে কোন কাজ থাকলে তুলে দিয়েছেন তাড়াতাড়ি। এই অভ্যাস তাকে একা থাকার ক্ষেত্রে কিংবা নিজের দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সংগ্রামের মধ্যে ফেলে দিবে। নিজের পরীক্ষা, প্রতিদিনের বিভিন্ন কাজের সময় ইত্যাদি সম্পর্কে তাকেই সচেতন হতে হবে। তাকে আগে থেকে কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী রুটিন করা শেখাতে পারেন। নিজের সারাদিনের সময়কে ভাগ করা। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা ও সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে পারার মতো কিছু স্কিল তার ভেতরে আগে থেকেই গড়ে তুলুন। তবে আপনার নিজের মধ্যে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও সঠিক পরিকল্পনার অভ্যাস থাকলে সন্তান এমনিতেই শিখে যাবে।
নিজের কাজ করতে শেখা
সন্তান বাসায় থাকলে তার ময়লা জামা হয়তো আপনি খুঁজে ধুয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে বাইরে গেলে সে কাজগুলো তো নিজেকেই করতে হবে। নিজের কাপড় নিজে ধোয়া, নিজের জামা নিজে ইস্ত্রি করা, বিছানা গোছানো, নিজের পড়ার টেবিলটি গুছিয়ে রাখা, নিজের রুম পরিষ্কার করা ইত্যাদি প্রতিদিনের নিজের কাজ নিজে করতে শেখার লাইফ স্কিল আপনার সন্তানের মাঝে থাকা জরুরী। এই কাজগুলো খুব যে কঠিন তা কিন্তু না! কিন্তু অভ্যাস না থাকলে এই কাজগুলোই তার জন্য কঠিন হতে পারে। আবার হুট করে টিনএজ সন্তানকে বলে দিলেন, কাল থেকে কিন্তু নিজের কাজ নিজের! এতে যে সে একদিনেই একদম নিজের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারবে বিষয়টা এমনও না। বরং একটু বড় হলে তার নিজের টুকটাক কাজগুলো বাসাতেই তাকে করতে দিতে পারেন। এতে সে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হবে ও একা থাকতে গেলে খুব একটা সমস্যায় পড়বে না।
টুকটাক রান্নাও শিখিয়ে দিন না!
ছেলে সন্তান হোক কিংবা মেয়ে সন্তান! টুকটাক শর্টকাট কিছু কিছু রান্নার রেসিপি আপনি আপনার সন্তানকে শিখিয়ে দিতেই পারেন। বুয়া না আসলে কীভাবে খাবে? বাইরের খাবারে গ্যাসের প্রবলেম হবে? এমন অনেক চিন্তাইতো মায়েদের মনে ভিড় করে। আপনার সন্তানের টুকটাক রান্নার স্কিল আপনাকে এমন অনেক চিন্তা থেকে মুক্ত রাখবে। বাসায় রান্না করার সময় সন্তানকে বলতে পারেন আপনাকে টুকটাক সাহায্য করার জন্য। তার পছন্দের কোন খারার রান্না করার সময়ও তাকে সাথে রাখতে পারেন। কিংবা মনোযোগ দিয়ে আপনার রান্না দেখার জন্যও বলতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এইসব অবশ্য কর্ম যেন না হয়। এতে সন্তান হয়তো বিরক্ত হতে পারে। বরং তার সাথে আড্ডা দেয়ার ছলেও এইসব তাকে শেখাতে পারেন।
সামাজিকতা ও আচরণগত দক্ষতা
আপনার সন্তান ঘরকুনো হতে পারে। হতে পারে অনেক বেশি অন্তর্মুখী। কিন্তু বাইরের পরিবেশে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ও পরিবেশের সাথে ভালোভাবে খাপ খাওয়ার জন্য তার মধ্যে সাধারণ সামাজিকতার গুণ উন্নয়নের প্রয়োজন। সেজন্য যে নিজের প্রাকৃতিক আচরণ থেকে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে বিষয়টা এমন না। একদম সাধারণ সামাজিকতা। কলেজের বন্ধু, হোস্টেলে বা মেসে থাকলে সেখানকার রুমমেট ও অন্যান্যদের সাথে সাধারণ সামাজিক অবস্থা বজায় রাখার বিষয়ে আপনার সন্তানকে একটু দক্ষ করে তুলুন।
নজর দিন তার আচরণের দিকেও। ভালো ও নৈতিক আচরণ দক্ষতা যেন তার ভেতরে ঘর থেকে গড়ে উঠে। এক্ষেত্রে তার কোন অনৈতিক বা অগ্রহণযোগ্য আচরণ চোখে পড়লে তা শুধরে দিন। নিজের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা, কাউকে ধন্যবাদ দেয়া ইত্যাদি গুণগুলো আপনার সন্তানের মাঝে গড়ে তুলুন।
সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা
সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা যে কোন টিনএজ সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জীবনের একটা সময় পরে সবারই নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। ছোট থেকেই যদি আপনি তার মাঝে সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতার উন্নয়ন করতে না পারেন তাহলে তার সারা জীবনে এর প্রভাব পড়বে। সব সময় তার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয়ার জন্য আপনি থাকবেন না। তার সমস্যা হাতে ধরে সমাধান করে দিবেন না। তার মধ্যে এই গুণগুলো গড়ে তুলতে ছোট থেকেই তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে দিন। আপনি সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু একেবারে সমাধান করে দিবেন না। সমাধানটা সেই করুক। হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে তার অন্যান্য যেকোন সমস্যার সমাধান তাকেই করতে দিন।
এইসব লাইফ স্কিল আপনার সন্তানকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। এমন না যে, বাড়ি থেকে বাইরে যাবে বলে সন্তানের মাঝে এসব দক্ষতা গড়ে তোলা জরুরী। বরং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত, যে কোন পরস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিটি মানুষের মাঝে এসব লাইফ স্কিল থাকা আবশ্যক।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,970 total views, 1 views today