পৃথিবীতে প্রতিদিন যত সংখ্যক নবজাতকের জন্ম হয়, একই সাথে জন্ম হয় তত সংখ্যক নতুন বাবা ও মায়েরও। প্রথম সন্তানের বাবা-মা হওয়া সব বাবা-মায়েদের জন্যই সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। সম্পূর্ণ নতুন এক যাত্রা। এবং এটি মানুষের জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে। তবে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটা অপ্রত্যাশিত বিষয় বলতেই হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানের বাবা-মা হিসেবে আমাদের প্রস্তুতিতে বেশ ঘাটতি থেকে যায়। যদি আরেকটু পরিষ্কার করে বলতে যাই, বাবা হিসেবে আমরা নিজেকে সম্ভবত শারীরিক, মানসিকভাবে অতটা প্রস্তুত করতে পারি না। মা হওয়ার জার্নিতে মায়েরা একদম সরাসরি যুক্ত থাকার ফলে ও আশেপাশের অভিজ্ঞ মায়েদের পরামর্শে মায়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে বেশ প্রস্তুত করে নিতে পারে। ব্যস্ততা, সদিচ্ছার অভাব, সচেতনতার অভাব কিংবা উপযুক্ত পরিবেশের অভাব যাই বলি না কেন আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবারা নিজেকে বাবা হিসেবে অতটা প্রস্তুত করে নিতে পারে না। আর পারে না বলেই অনেকক্ষেত্রে বাবা হওয়ার চ্যালেঞ্জটা আমাদের কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। এই চ্যালেঞ্জটিকে গ্রহণ করতে একজন নবজাতকের পিতা হিসেবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে নিজেকে সঠিকভাবে তৈরি করে নিতে হবে।
বাবা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলার কিছু টিপস নিয়ে বিজ্ঞানবাক্স ব্লগ থাকতে চায় আপনার সাথে।
বাবা হওয়ার জন্যও করতে হবে পড়ালেখা
একজন বাবা হওয়ার জন্য শুরুতেই নিজেকে বাবা হিসেবে সমৃদ্ধ করতে হবে। বিষয়টা একদম কোমর বেঁধে নামার মতো না আসলে। সন্তানের অস্তিত্ব টের পাওয়ার পর থেকেই অল্প অল্প করে নিজেকে সমৃদ্ধ করা শুরু করতে পারেন। বিভিন্ন প্যারেন্টিং বই পড়তে পারেন কিংবা অনলাইন সোর্স থেকে জেনে নিতে পারেন টুকিটাকি। পরিচিত বাবাদেরকে এইসময়ে একটু জ্বালান। তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের চ্যালেঞ্জগুলো জেনে নিন। নিজের মধ্যে বাবা বাবা অনুভূতিকে আরো জোরদার করতে বন্ধুদের সাথে সন্তানের নাম নিয়ে আলোচনাও করতে পারেন কিংবা সন্তানের নাম নিয়ে আপনার সহযাত্রীর সাথে এক ঝলক খুনসুটি কিংবা মজার ঝগড়া করে নিতে পারেন। ও হ্যাঁ, ডায়াপার চেঞ্জ করাটাও দেখুন। মানে শিখে রাখা আরকি! কাজটি সহজ যদিও। তাও একটু দেখে নিলেন।
প্রথম বছরের জন্য বিশেষ মানসিক প্রস্তুতি
আমাদের বিজ্ঞানবাক্স টিমের নতুন বাবাদের একজন আদনান ভাই। প্রায়ই সকালে আদনান ভাইয়ের চোখ লাল থাকে। কারণ একটাই। বাচ্চাটা জেগে গেলো মাঝরাতে, আর ঘুমালো না। মাঝে মাঝে আদনান ভাই মশা মারা সর্দার হিসেবেও নিজেকে আবিষ্কার করে। মশারীর ভেতরে মশা ঢুকে গেলে সেই মশা মারা ছাড়া ঘুমানো তো যাবেই না।
নবজাতক শিশু সম্পর্কে আপনাকে একটা বিশেষ তথ্য দেই। জন্মের প্রথম বছরে শিশুরা একটু নিশাচর স্বভাবের হয়ে থাকে। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে মাঝরাতে জেগে যাবে আর ঘুমাবে না। সন্তান জেগে গেলে আপনি আর কী করে ঘুমাবেন! প্রথম বছর আসলেই বিশেষ মানসিক প্রস্তুতির দরকার পড়বে। বাচ্চার ফিডিং, ডায়াপার পরিবর্তন করা, স্বাস্থ্য জটিলতা সবমিলিয়ে এই সময়টাতে বেশ চাপ যাবে। খাওয়া, ঘুম, কাজসহ প্রায় সব ধরণের রুটিন পরিবর্তন হয়ে যাবে।
বাবুদের কোন সময় জ্ঞান থাকে না। দেখা গেলো সদ্য খাইয়ে দাইয়ে ভালো জামা পরিয়ে একটু অবসর হলেন ওমনি সে কান্না জুড়ে দিলো। গিয়ে দেখলেন আবারো নষ্ট করেছে ডায়াপার, ভিজিয়ে দিয়েছে বিছানা বা ন্যাপি। ভোররাতে তার ক্ষিদে লাগতেই পারে। কিংবা হুট করে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে আজ সারারাত জেগে থাকবে! এরকম সময়ে বাবা-মা দু-জনে মিলে সন্তানের কাজগুলো করুন। নিজের প্রতি চাপও কমবে ও সম্পর্কটাও সুন্দর হবে।
পেটারনাল পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন সম্পর্কে সচেতন থাকুন
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন সাধারণত মায়েদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। প্রথম সন্তান জন্মদানের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে অনেক মায়েরা মানসিক অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক জটিলতা, গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানকালীন জটিলতার কারনে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভোগেন। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের কারণে সন্তান লালন পালন ও স্বয়ং সন্তানের প্রতিও মায়েদের এক ধরণের বিরক্তিবোধ কাজ করে। অনেক মায়েরা সন্তানের ক্ষতি করার চিন্তাও করে থাকেন। সম্প্রতি আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে শতকরা ১০ শতাংশ বাবারাও প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে পেটারনাল পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভোগেন। কেউ কেউ স্ত্রীর অস্থিতিশীলতার কারণে আক্রান্ত হন। কেউ কেউ হুট করে জীবনযাপনের পরিবর্তনটার সাথে অভ্যস্ত হতে পারেন না। ফলে একধরণের বিরক্তিবোধ কাজ করে নিজের ভেতর। যা থেকে হতে পারে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের শুরুর দিকে আপনার ভেতরে ধীরে ধীরে বিরক্তিবোধ, অস্বস্তি, সন্তানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, সন্তানকে বোঝা মনে হতে শুরু করা; ও সর্বশেষ পর্যায়ে নিজের ও অন্যের অথবা সন্তানের ক্ষতি করতে চাওয়া; ইত্যাদি লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করবে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে লজ্জা পাবেন না কিংবা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন না। নিজেকে সময় দিতে চেষ্টা করুন, অন্যের সাথে বিষয়গুলো শেয়ার করুন ও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।
সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন
সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়া ও ধাপগুলো সম্পর্কে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা অনেক বেশি জরুরী। আপনি যদি এই প্রক্রিয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত থাকেন তাহলে ধাপগুলো বেশ সহজ ও জামেলামুক্ত হবে। ধাপগুলো যে খুব কঠিন তা কিন্তু না। তবে আগে থেকে প্রস্তুত না থাকলে এই সহজ ধাপগুলোই আপনার জন্য হয়ে যেতে পারে অনেক কঠিন। রক্তের কথাটিই ধরুন, আগে থেকে রক্তদাতা প্রস্তুত করে না রাখলে তৎক্ষণাৎ রক্তদাতা কিংবা রক্ত পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যাবে। সেজন্যই সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা ভালো। রক্তদাতা প্রস্তুত করে রাখা, আর্থিকভাবে প্রস্তুত থাকা, অফিস বা ব্যবসার কাজ থেকে আগে থেকেই ছুটি নিয়ে রাখা, হাসপাতাল সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিয়ে রাখা, অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা ইত্যাদি কাজগুলো ডাক্তারের সাথে কথা বলে আগেই পরিকল্পনা করে রাখতে পারেন।
শিশুর প্রয়োজনীয় উপকরণ সম্পর্কে সচেতন হোন
শিশুদের ত্বক থেকে শুরু করে শরীরের বাকিসব অংশ বেশ স্পর্শকাতর হয়। একই সাথে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় থাকে। ফলে শিশুদের শরীর অনেক কিছুতেই প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে শিশুর জামা-কাপড়, খাদ্য থেকে শুরু করে সকল ধরণের প্রসাধনী সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিয়ে রাখুন। কোনটা ব্যবহার করবেন, কোনটা করবেন না। কোনটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে ইত্যাদি জেনে নিতে পারেন।
আরো পড়ুন-নবজাতকের যত্নে ১০ টি ভুল ধারণা।
সন্তানের সাথে বন্ধন দৃঢ় করুন
সন্তানের অস্তিত্ব টের পাওয়ার পর থেকেই একটা বন্ধন আপনার মাঝে তৈরি হয়। নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসলে তখন থেকেই শুরু হয়। কিন্তু সন্তান জন্মদানের পর জীবন যাপনের একটা পরিবর্তন ও আরো নানান জটিলতায় অনেকে নবজাতকের সাথে বন্ধন নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না বা নিজেকে যতটুকু যুক্ত করা দরকার ততটুকু করেন না। তবে শিশুর সাথে বাবা হিসেবে আপনার বন্ধন দৃঢ় থাকা বেশ দরকার। গবেষণা বলছে, শিশুর সাথে বন্ধন দৃঢ় করার জন্য চোখে চোখ রাখা ও পাশাপাশি মৌখিক বা শারীরিক অঙ্গভঙ্গীতে শিশুর সাথে খেলা করা, শারীরিক স্পর্শ (শুরু থেকেই কোলে নেয়া) অনেক বেশি কার্যকরী। শিশুর ডায়াপার চেঞ্জ করা, ফিডিং, খাওয়ানো সব কাজে আপনার সমান ও স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণও পারে শিশুর সাথে আপনার বন্ধনকে দৃঢ় করতে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,797 total views, 2 views today