ক্লাসের সময় দুষ্টুমি বা বাইরে তাকিয়ে থাকার জন্য স্যারের হাত থেকে তীব্র গতিতে আপনার দিকে ধেয়ে আসা চক আর ডাস্টারের কথা মনে আছে?
মনে আছে সেইসব সমীকরণের কথা? পাহাড় সমান কনফিডেন্ট নিয়ে তুড়ির জোরে সমাধান করে ফেলবেন ভেবে পরীক্ষার খাতায় ফেলে আসা সেইসব অসমাপ্ত সমীকরণের কথা?
এতটুকু মনে না থাক! অফিসের কিংবা ইউনিভার্সিটির প্রেজেন্টেশন বা অ্যাসাইনমেন্টে করা ভুল গুলোর কথা তো মনে আছে? যেগুলোর জন্য বস বা স্যার আপনার উপর রাগ দেখাতে দেখাতেও দেখাননি! রাগ না দেখালেও বলে দিয়েছে, ফোকাস আরো উন্নত করো ম্যান!
এই ফোকাসহীনতার কথা যে কেবল আপনি শোনেন এমন না! আমাদের প্রজন্মের ফোকাস নিয়ে অভিযোগ বলা যায় সবার। অফিসের বস, বাবা-মা থেকে শুরু করে প্রেমিক-প্রেমিকাও ফোকাস নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকি ছোটরাও কখনো কখনো বলে ফেলে, আমাদের নাকি ফোকাস নাই! কী ভয়াবহ ব্যাপার!
আমাদের ফোকাস এর উপর আস্থাহীনতার কথা বলেছেন জাফর ইকবাল স্যারও। তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, ফোকাসহীনতার জন্য জাফর ইকবাল স্যার আমাদের দায়ী করেননি। তিনি দায়ী করেছেন ইন্টারনেটকে! গত ফেব্রুয়ারিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেন। শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগের ক্ষেত্রে উনি খেয়াল করেছেন যে, ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগের ও পরের প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝে ফোকাসের বিরাট ফারাক। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এই দুই প্রজন্মের মধ্যে আমাদের প্রজন্মেরই ফোকাস কম!
তারা যে খুব একটা মিথ্যা বলে তাও কিন্তু না! ঘটনা সত্য। আমার কাছে তথ্যও আছে। পড়ুন মনোযোগ দিয়ে।
তথ্য
বোস্টন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গত বছর একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়! গবেষণার অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের ১৫ মিনিট ধরে স্মার্টফোন সামনে নিয়ে বসে থাকতে বলা হয়। শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, তারা কোনভাবেই এই ১৫ মিনিট নিজেদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারবে না।
তারা কেউ যদিও এই ১৫ মিনিট নিজেদের স্মার্টফোন ব্যবহার করেনি। কিন্তু ১৫ মিনিট ধরেই তাদের মাঝে ভয়ানক কোন এক নেশাদ্রব্যের অভাব বোধ করার মতো অস্থিরতা দেখা গেছে।
বাংলাদেশ টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য মতে বর্তমানে সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আর এই সংখ্যাটির বেশিরভাগই যে তরুণ তাতে কোন সন্দেহ নাই।
ফলে দেখাই যাচ্ছে ফেসবুক, গুগল ,ইন্সট্রাগ্রাম, ইউটিউব আমাদের ফোকাসকে প্রবল ফোকাসে নিজেদের দিকে টেনে নিচ্ছে!
সব দোষই কি আসলে প্রযুক্তির?
এই আধুনিকতার যুগে এসে অনেকে এমন মনে করে থাকেন। মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। চারপাশে এত এত বৈচিত্রপূর্ণ সবকিছু। গবেষকরাও প্রযুক্তির আধুনিকতাকে কিছুটা দোষ দিচ্ছেন! কিছুটা! হ্যাঁ, কিছুটাই!
গবেষণা কী বলছে?
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রকাশনা সংস্থা এমআইটি প্রেস ‘দ্য ডিসট্রাকটেড মাইন্ড; অ্যানসিয়েন্ট ব্রেইনস ইন আ হাই-টেক ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি দারুণ গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেন। বইটি লিখেছেন, বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যাডাম গাজালি ও মনোবিজ্ঞানী ল্যারি ডি রোজেন। ব্যাপক সাড়া জাগানো এই বইতে বলা হয়েছে, সব দোষ হাই-টেক ওয়ার্ল্ডের না, মূলত অনেকাংশেই দোষটা আমাদের মস্তিষ্কের। আমাদের মস্তিষ্কই আমাদেরকে বার বার বৈচিত্রতার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এবং আমরা চাইলেই আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারি।
একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, মনোযোগ নষ্ট করার মতো উপাদান মানুষের জীবনে সবসময়ই ছিলো। এই প্রযুক্তির যুগে উপাদানগুলো একটু বেড়েছে কেবল। এই বাড়তি উপাদানগুলো নিয়ে একটু বাড়তি সচেতনতাই কিন্তু আমাদের মনোযোগহীনতা কাটয়ে উঠতে সাহায্য করবে!
সবই বুঝলেন! কিন্তু আপনার যে ফোকাসে দুর্বলতা আছে তা কীভাবে বুঝবেন?
একটু ফোকাস করলেই দেখবেন, কোন ধরণের এলার্ম ছাড়াই আপনি কাজের ফাঁকে টুপ করে একবার ঢুকে পড়েন ফেসবুকে। কিন্তু ফেসবুকে এতটাই ফোকাস দেন যে, নোটিফিকেশন চেক করতে ঢুকে কাটিয়ে দেন ননস্টপ স্ক্রলিংয়ে। ফলাফল, নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারেন না কাজ। শোনেন বসের বকা।
ইউটিউবে ঢুকে একটা ভিডিও পুরো শেষও করতে পারেন না। পাশে থাকা সাজেশন বার থেকে ঢুকে যান অন্য কোন ভিডিওতে।
কখনো বা পাবজি, পোকেমন বা সিওসি-তে ঢুঁ দিতে ইচ্ছে করে একটু।
এমন হাজারো জিনিস কাজ ও পড়ালেখা থেকে আপনার মনোযোগ কেড়ে নেয় নিজের দিকে।
ফলে পড়ালেখা বা কাজ বা অ্যাসাইনমেন্টে দিতে পারেন না নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ। শেষ করতে পারেন না সময় মতো! শেষ করলেও তা কিছুটা যাচ্ছে-তাই ভাবেই করেন।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমাদের নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ কেড়ে নেয়। আপনার প্রতিদিনের জীবনে একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এমন অনেক কাজই আপনি করেন যা আপনাকে একটি নির্দিষ্ট কাজে নিরবচ্ছিন্ন ফোকাস ধরে রাখতে বাধা দেয়।
নিরবচ্ছিন্ন ফোকাস কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম প্রোডাক্টিভ মানুষ। তিনি মাত্র ৬১ বছরের মত বেঁচে ছিলেন (১৮৫৮-১৯১৯) । কিন্তু এই ছোট জীবনেই তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়েছেন, সেনাবাহিনীতে কর্নেল হয়ে যুদ্ধ করেছেন, নিউইয়র্কের গভর্নর হয়েছেন, এবং মাত্র ৪২ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, এতকিছুর মাঝে তিনি ৪০টি বই রচনা করেছেন!
রুজভেল্টের কাজ করার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিলো একটি নির্দিষ্ট কাজে নিরবচ্ছিন্ন ফোকাস ধরে রাখা। পরবর্তীতে তার কাজ করার পদ্ধতি নিয়ে বেশ গবেষণাও হয়। এরপর ‘রুজভেল্ট ড্যাশ’ নামে তার কাজ করার কৌশলের একটা নামও দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী অনেক প্রোডাক্টিভ মানুষই রুজভেল্ট ড্যাশ পদ্ধতি মেনে কাজ করেন। (রুজভেল্টের কাজ করার প্যাটার্ন নিয়ে আমরা শেষের দিকে একটু জানবো।)
যে কোন কাজ বিশেষ করে মাথা খাটিয়ে যা করতে হয় তার সফলতা নির্ভর করে সেই কাজের প্রতি মনোযোগ প্রদানের উপরে। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন এবং আলবার্ট আইনস্টাইনকে সর্বকালের সেরা দুইজন বিজ্ঞানী বলা হয়। ইনারা যখন কোনো সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতেন তখন এতোই গভীরে ঢুকে যেতেন যে পারিপার্শ্বিকতা ভুলে যেতেন। এসব নিয়ে মাঝে মাঝে হাস্যকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতো।
শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে না, যে কোন কাজে সফলতা ও সেরা কিছু বের করে আনার জন্য একাগ্রচিত্ততা অত্যন্ত জরুরী। গভীর মনোযোগে আপনি দশ ঘন্টার পড়াশোনা দুই ঘন্টায় শেষ করে ফেলতে পারেন। মনোযোগের সাথে করা অফিসের কোন প্রজেক্ট ছাড়িয়ে যাবে সেরার মান।
এমন কী আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা সমাধান বা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতেও দিতে হবে গভীর মনোযোগ।
ফোকাসহীনতার এই অপবাদ থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন? কীভাবে বাড়াবেন ফোকাস?
কোন কাজে ফোকাস ধরে রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী রুজভেল্ট ড্যাশ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজবেল্ট এই পদ্ধতিতে কাজ করতেন। তিনি শুরুতেই কাজের গুরুত্ব বুঝে অনেকগুলো কাজ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বেছে নিতেন। এরপর কাজটি করতে কত সময় লাগতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করতেন। এরপর সেট করতেন ডেডলাইন। ডেডলাইন সেট করার ক্ষেত্রে একটি মজার কাজ করতেন তিনি। উনি নিজের করা সম্ভাব্য সময়ের চেয়ে কিছুটা কম সময় নিয়েই ডেডলাইন ফিক্সড করতেন। অনেকটা নিজেকে নিজেই চ্যালেঞ্জ দেয়ার মতো বিষয়।
এরপর তিনি ডেডলাইন অনুযায়ী কাজটিকে শেষ করে ফেলার চেষ্টা করতেন। যদি কাজটি পারফেক্ট নাও হতো তাও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতেন।
তবে কাজ শুরু করার পর থেকে শেষ করা পর্যন্ত তিনি সবকিছু বাদ দিয়ে একদম এবং একদম সব মনোযোগ ওই একই কাজের পেছনে ব্যয় করতেন।
আরে ভাই, রুজভেল্টতো মনোযোগ একটা মাত্র কাজে দিতে পারতো! আমিতো পারি না। আমাকে তো ফেসবুক, ইন্টারনেট ব্ল্যাকহোলের মতো টেনে নিয়ে যায়! আমি কী করবো!
সুইচ অফ করে দিন!
কাজ করার সময় ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের সুইচ অফ করে দিন। ইন্টারনেটের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নিন।
একসাথে একাধিক কাজ নয়
একসাথে একটা মাত্র কাজ করুন। আমাদের মস্তিষ্ক একসাথে একাধিক কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকে না। কাজের প্রায়োরিটি সেট করে একটা শেষ করে অন্যটা ধরুন।
শারীরিক ব্যায়াম
শারীরিক ব্যায়াম ফোকাস সন্নিবেশিত করতে সাহায্য করে। শারীরিক ব্যায়াম শরীরের পাশাপাশি আপনার মস্তিষ্ককে শান্ত ও সুস্থ রাখে।
মেডিটেশন করুন। মেডিটেশন নিরবচ্ছিন্ন ফোকাস বাড়াতে বেশ ফল দেয়।
সবুজের কাছে যান
আপনার বন্ধু সবুজের কাছে যান। এরপর তাকে নিয়ে প্রকৃতির কাছে যান। তারও ফোকাসে সমস্যা থাকতে পারে। প্রকৃতি, সবুজ গাছ-পালা মানুষের মন ভালো করে। নিয়মিত বিরতিতে একটু প্রকৃতির কাছ থেকে ঘুরে আসলে ফোকাসটাও বাড়বে।
কাজে অল্প সময়ের বিরতি দিন
একটানা কাজ করলে অবসাদ ও বিরক্তিও চলে আসতে পারে। কাজের ফাঁকে ৫-১০ মিনিটের বিরতি দিয়ে চা, কফি খেয়ে নিতে পারেন। তবে হ্যাঁ, ৫-১০ মিনিটই, এর বেশি না!
প্রথমে সহজ কিছু দিয়ে শুরু করুন
কাজের সহজ অংশ দিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। তাহলে বিরক্তি আসবে না। কাজের প্রতি অনীহাও আসবে না। ফোকাসও ধরে রাখতে পারবেন।
ফোকাস বাড়াতে পারেন বিভিন্ন ধরণের ব্রেইন গেমের মাধ্যমেও!
এরমধ্যে শব্দজট অন্যতম। রুবিক্স কিউব ফোকাসকে এক জায়গায় সন্নিবেশিত করতে বেশ সাহায্য করে।
ফোকাসকে সন্নিবেশিত করতে সাহায্য করে এমন আরো একটা টুলসের কথা আমি আপনাকে বলতে পারি। এই টুলসটার নামই ফোকাস চ্যালেঞ্জ।
এটা অনেকটা Buzzwire গেমের মিনি ভার্সন। এটি খেলার জন্য আপনাকে দিতে হবে সর্বোচ্চ মনোযোগ। ফোকাসের একটু নড়চড় হলেই আপনি খেলাটি সম্পন্ন করতে পারবেন না। একটা নির্দিষ্ট সময় এই খেলা খেলার ফলে দিনে দিনে আপনার ফোকাস বাড়তে থাকবে। ফোকাস চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আরো ভালো করে জানতে এই লিংক থেকে ভিডিওটি দেখে আসুন।
নিরবচ্ছিন্ন ফোকাস ধরে রাখা কিছুটা কঠিনই বটে। আপনি একদিনে নিজের ফোকাসকে ঠিক করে ফেলতে পারবেন না। বেশ কিছুদিন প্র্যাকটিস, রুটিনমাফিক চলা ও ফোকাস নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য চেষ্টা করার ফলে ধীরে ধীরে আপনার ফোকাসের উন্নতি হবে। আর ফোকাসের উন্নতি হলে নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করতে পারবেন। আপনি, আমরা, আপনার পরিবার কিংবা এই পৃথিবীর প্রয়োজনে আপনার সামর্থ্যের পরিপূর্ণ ব্যবহার তো আপনিও করতে চান।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,335 total views, 1 views today