“১৪, ১৫ বছরের বালকের মতো এমন বালাই পৃথিবীতে আর নেই” ছুটি গল্পের কথা মনে আছে তো? ছুটি গল্পের ফটিকের কথা বলুন কিংবা আপনার টিনএজ সন্তানের কথাই বলুন, ছেলের কথা বলুন বা মেয়ের কথাই বলুন না কেন! টিনেজারকে নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা কঠিনই বটে। এই সময়ে তাকে যা করতে নিষেধ করা হবে সেটা করতেই যেন তার যত আনন্দ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, রাত করে বাড়ি ফেরা, হুটহাট এদিক সেদিক চলে যাওয়াই যেন তার ব্রত। আর বাবা-মা একটু বোঝালে ভাববে, বাবা-মা শুধু জ্ঞান দেয়! কড়া ভাষায় কিছু বললে তো রেগেমেগে কেউ কেউ বিদ্রোহও করে বসে।
সন্তান কথা শুনবে না! কড়াভাবে বললে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিতে-বিপরীত হবে! তাহলে এই সময়টাতে আসলে কী করা উচিত! ঠিক এখানেই তার সাথে একটা সেতু বন্ধন তৈরি করতে হবে আপনাকে। একটু সচেতনভাবেই সন্তানের ইচ্ছার সাথে আপনার অনুশাসনকে মিলিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে? এটাই আজকের ব্লগের বিষয়বস্তু।
টিনএজ সন্তানের সাথে সবচেয়ে সুন্দর ও ফলপ্রসূ যোগাযোগ কীভাবে হবে?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মা চঞ্চল, বহির্মুখী ও নিয়ন্ত্রনহীনতার মাঝে তফাৎ করতে পারেন না। সন্তান একটু বেশি বহুর্মুখী হলেই ধরে নেন সে গোল্লায় গেছে। এরপর সন্তানকে একদম পুরোদমে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তখনই মূলত জটিলতাটি সৃষ্টি হয়। মনে রাখবেন, সন্তান ছোট হলেও তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আপনি যখন তার সবকিছুকে একপাশে রেখে আপনার মতামত তার উপর চাপিয়ে দিতে যাবেন তখনই তার সাথে আপনার দূরত্বটা বেড়ে যাবে।
কী করবেন?
শুনুন শুনুন এবং শুনুন
সন্তানের কথা শোনার চেয়ে বলার প্রবণতা বেশি অনেক বাবা-মার মাঝেই। এটা করবে না, ওটা করবে না; ইত্যাদি বিষয় শুধুই শুনিয়েই যায় অনেকে। স্কুল কেমন লাগছে? এটা জানার চেয়ে, স্কুলে আজকে সব পড়া পেরেছে কি না, তা জানার আগ্রহই বেশি। আপনি যদি সবসময় সন্তানকে পরীক্ষার ফলাফল কী? হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করেছে কি না! ইত্যাদি প্রশ্ন করতে থাকেন ও তার কাছে হ্যাঁ-সূচক উত্তর আশা করেন তাহলে সন্তানের সাথে আপনার কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে। সন্তানের মাঝে মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হবে। সে আপনার মন মতোই উত্তর দিতে চাইবে। আপনার ঠিক করে দেয়া উত্তরের জন্য না, বরং সন্তানকে প্রশ্ন করুন তার অনুভূতি, ভালো লাগা, খারাপ লাগা শোনার জন্য। বন্ধুদের কথা জানতে চান। ক্লাসের মজার কোন ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। কোন স্যারকে বেশি ভালো লাগে তা জানতে চাইতে পারেন। এতে সে তার অনুভূতিটা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারবে। নির্দ্বিধায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারার ফলে আপনার প্রতি তার আস্থা জন্মাবে। কোন কিছু লুকানোর প্রবণতাও কমে যাবে।
সন্তানের ভরসার জায়গা হতে চেষ্টা করুন
ভরসার জায়গা হতে হলে সন্তানের কাছে বন্ধুর মতো হতে হবে আগে। “আমি তোমার বন্ধুর মতো, আমাকে সব বলতে পারো” এই কথাতেই সন্তান আপনাকে সবকিছু বলে দিবে না! আপনি তার ভরসার জায়গা, এই বিশ্বাসটি সন্তানের মাঝে আগে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে? প্রথম ধাপ যদি বলি, তাহলে ব্লেইম গেম খেলা বাদ দিতে হবে। ফলাফল খারাপ, ভুল করা কিংবা তার কোন অপারগতার জন্য তাকে দোষ দেয়া বা তাকে অযোগ্য না বলে সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করা ও তাকে পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করুন। সে যখন বুঝতে পারবে তার অপারগতা, ভুল ও সমস্যাগুলোকে আপনি নিজের সমস্যা হিসেবে নিয়ে তাকে তা সমাধানে সাহায্য করছেন তখনই কেবল সে আপনার উপর ভরসা করবে। তখনই আপনি তার বন্ধু হতে পারবেন। তার ভরসা করার মতো হতে পারলেই আপনি তাকে ভুলগুলো সম্পর্কে বলতে পারবেন। সে তা ইতিবাচকভাবেই নিবে। সহজে মেনেও নিবে।
তার প্রতি আপনার বিশ্বাসের কথাও বলুন
আপনি সবসময় টিনএজ সন্তানকে চোখে চোখে রাখতে পারবেন না। সব সময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করাও ঠিক নয়। সন্তান যদি আপনাকে মিথ্যা বলে তাও আপনি তৎক্ষণাৎ ধরতে পারবেন না! এক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি আপনার বিশ্বাসকে তুলে ধরুন। নৈতিকতা, অনৈতিকতা, দোষ, ভুল, ভালো, খারাপ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ছোট থেকেই তার মধ্যে ধারণা জন্মান। ও একই সাথে আপনি তার কাছ থেকে কী কী আশা করেন তা তাকে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। আপনার প্রতি তার বিশ্বাস ও তার প্রতি আপনার বিশ্বাস; এ দুটির বন্ধন যত ভালো হবে তত বেশি আপনি তার সাথে মিশতে পারবেন। তার ভুলগুলো যেমন জানতে পারবেন একই সাথে তার কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতাও তত বাড়বে। আপনার কাছে সে নিজেই পরামর্শ চাইবে ও আপনার পরামর্শকে গুরুত্বের সাথে নিবো।
তার বন্ধুদের সম্পর্কে জানুন
টিনএজ বয়সী ছেলে-মেয়ের কাছে কখনো কখনো বাবা-মায়ের চেয়ে বন্ধুরা বেশি কাছের হয়ে থাকে। ভালো, মন্দ সব ধরণের পরিবর্তনের পেছনে অনেক বেশি অবদান থাকে বন্ধুদের। মজায় মজায় বন্ধুরা মিলেই হয়তো কোন অনৈতিক কাজ করে ফেলতে পারে। বিশেষ করে নেশা ও ছোট খাটো অবাধ্যতা বা অনৈতিক ও বাজে কাজগুলো যেকেউ প্রথমে বন্ধুদের সাথেই করে। যদি শুধু ধূমপানের কথাও ধরি, শুরুটা বন্ধুদের সাথেই হয়। সেজন্য সন্তানের বন্ধুদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখার চেষ্টা করুন। বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চান। বাসায় আসতে বলুন। কিংবা তার বন্ধুদের বাসায় গিয়েও পরিচিত হয়ে আসতে পারেন। এবং কোন বন্ধুর আচরণ আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলে সেই বন্ধু সম্পর্কে আপনার সন্তানের কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করুন। সন্তানের সাথে যদি আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাহলে সে আপনাকে তার বন্ধুদের খারাপ অভ্যাস সম্পর্কেও বলবে। এবং ক্ষতিকর বন্ধুর সাথে না মেশার ব্যাপারে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলুন।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন
সন্তানের কোন ভুল চোখে পড়লে, কোন ব্যর্থতা বা অপারগতা সামনে আসলে সবার আগে আমরা রেগে যাই, সন্তানকে হেয় করে কথা বলি। ফলাফল, সন্তান সবসময় নিজের ভুলগুলোকে লুকাতে চেষ্টা করে। স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে বাবা-মার সাক্ষর নকল করার ধারা হয়তো বাবা-মায়ের রেগে যাওয়ার ফলাফল স্বরূপই এসেছে। ফলাফল খারাপ হয়েছে, আপনাকে দেখালেইতো আপনি রেগে যাবেন, বকাঝকা করবেন। সবসময় বকাঝকা খেতে হলে, সন্তানকে আপনাকে তার রিপোর্ট কার্ড কেন দেখাবে? ফলাফল খারাপ কিংবা যেকোন ধরণের অগ্রহণযোগ্য আচরণে আপনার মেজাজ বিগড়ে যেতেই পারে। কিন্তু সন্তানের ভালোর জন্য নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তৎক্ষণাৎ নেতিবাচক কোন আচরণ না দেখিয়ে চেষ্টা করুন তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে ও পরবর্তিতে তার সমস্যাটি নিয়ে তার সাথে আলোচনা করতে।
প্রশংসা করুন
মনে করে দেখুনতো, সর্বশেষ কবে সন্তানের সামনে তার প্রশংসা করেছেন? আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবা-মা’ই সন্তানের সামনে তার প্রশংসা করতে চান না। তারা মনে করেন, বেশি প্রশংসা করলে সন্তান বিগড়ে যাবে। কিন্তু শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কোন কাজের জন্য প্রশংসা করলে তারা ওই একই কাজ করার জন্য আগ্রহ পায়। আপনার টিনএজ সন্তানের মাঝে হয়তো প্রশংসা করার মতো গুণ কম আছে! কিন্তু সেই কম গুণের প্রশংসা যখন আপনি করবেন তখন সে নিজেও আরো ভালো কিছু করার চেষ্টা করবে। সন্তানের যে কোন সাফল্যের জন্য সন্তানের প্রশংসা করার চেষ্টা করুন। হোক সাফল্যটা ছোট! এতে সন্তান আত্মবিশ্বাস পাবে ও একই সাথে নিজের খারাপ অভ্যাসগুলোকে ভালো অভ্যাসে রূপান্তর করার আগ্রহ পাবে।
সন্তানের সমস্যাগুলো সমাধানে একসাথে কাজ করুন
টিনএজ সন্তানের সমস্যাগুলোকে নিজের সমস্যা ভাবার চেষ্টা করুন। অবশ্য সব বাবা-মা’ই সন্তানের সমস্যাকে নিজের সমস্যাই ভাবে। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সন্তানকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে বকাঝকা কিংবা কড়া শাসনকেই নিজের দায়িত্ব ভেবে নেয়। বকাঝকা নয়, সন্তানকে পরামর্শ দেয়ার দিকে বেশি নজর দিতে হবে। ধরুন, আপনার টিনএজ সন্তানের ধূমপানে আসক্ত হওয়ার বিষয়টি আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এক্ষেত্রে সন্তানকে বকাঝকা না করে ধুমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করুন ও তাকে বোঝাতে চেষ্টা করুন। একই সাথে ধুমপান ত্যাগ করার জন্য সন্তানকে সাথে নিয়েই পরিকল্পনা করুন ও পরিকল্পনার বাস্তবায়নে তাকে সাহায্য করুন। একই কাজ করুন পড়ালেখায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না আসলেও। তার দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে তা কাটিয়ে উঠার জন্য একসাথে কাজ করুন। তার অগ্রগতির দিকে নজর রাখুন ও তাকে কোন পরামর্শ দেয়ার প্রয়োজন মনে করলে পরামর্শ দিন।
সন্তানের আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন
বলা হয়ে থাকে, সন্তান বাবা-মায়ের শৈশবের প্রতিবিম্ব! শৈশবের সময়টা আপনিও পার করে এসেছেন। এই সময়ের আচরণ ও আগ্রহ সম্পর্কে আপনারও ধারণা আছে। আপনি যদি আপনার সন্তানের আচরণগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে পরিবর্তনটি বেশ সহজেই বুঝতে পারবেন। সন্তানের আচরণে, চলাফেরার কোন নেতিবাচক পরিবর্তন দেখলে সন্তানের সাথে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করুন। তাকে ভরসা দিন ও সমস্যা উতরে সুন্দরভাবে আবার সব শুরু করার জন্য সাহায্য করুন।
আরো পড়ুন-সন্তানকে কতটুকু শাসন করবেন?
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
2,071 total views, 1 views today