শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হন। হয়তো কোন একদিন শৃঙখলার সমস্যা, কেউ কোন কথা শুনতে চাইছে না, আবার হয়তো শিক্ষক কোনভাবেই পুরো ক্লাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। আবার অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন না, কেউ কেউ বহু চেষ্টাতেও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কাড়তে পারেন না। ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে কমিউনিকেশন, টিচিং টেকনিক, টিচিং মেথড ও আরও অনেক ধরণের সমস্যার সমাধান নিয়ে লিখছি, ’ক্লাসরুম টিপস’। শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নন, হোমস্কুলিং-এর সময়ে অভিভাববেকরাও এই টিপসগুলো কাজে লাগাতে পারেন।
এডুকেশন সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্র্যাক্টিকাল দিক হল শিক্ষণ বা টিচিং। আধুনিক শিক্ষা ভাবনায় শিক্ষার লক্ষ্য, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাঠ্যক্রম, শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণার যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি টিচিং এর কৌশল বা পদ্ধতির ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। একটা সময়ে শিক্ষা অসংগঠিত ছিল যা বর্তমানে কিছুটা স্ট্রাকচারড হয়েছে। সেভাবেই টিচিং মেথডও অসংগঠিত অবস্থা থেকে বর্তমানে একটা কংক্রিট রূপ ধারণ করেছে।
আধুনিক ধারণা অনুযায়ী, সামগ্রিক জ্ঞানের সাথে যখন শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক তৈরি হয়, তখনই তাকে এডুকেশন বলা যেতে পারে। শিক্ষকের কাজ হল জ্ঞানের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক তৈরি করা আর এই সম্পর্ক তৈরীর জন্য শিক্ষক যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন তাকেই বলা হয় শিখন পদ্ধতি বা টিচিং মেথড।
আদিম যুগে টিচিং বা শেখানোর বিষয়টাকে শুধুমাত্র শিক্ষকের এ্যাক্টিভিটি বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখন শিক্ষকের সাথে সাথে শিক্ষার্থীর অ্যাক্টিভিটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এ্যক্টিভিটির মাধ্যমে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুর সাথে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক তৈরি হয় তাকেই সাধারণভাবে বলা যেতে পারে শিখন পদ্ধতি।
একটা সময় মনে করা হতো মানুষের মন কয়েকটি নিরপেক্ষ শক্তির সমন্বয়ে গঠিত। এই ধারণা শিক্ষা ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেছিল। চর্চা ও অনুশীলনের দ্বারা শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তিকে যত বেশি ডেভেলপ ও অ্যাক্টিভ করে তোলা যায়, সেটিই ছিলো শিক্ষকের প্রধান কাজ। তাই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করতেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা মনে করে, মানুষের মন একটি সামগ্রিক সত্ত্বা। মানুষ বস্তু জগতের মধ্যে থেকে খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।এভাবেই সে সামগ্রিক অভিজ্ঞতাকে সংরক্ষণ করে।অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্তের এক্সপেরিয়েন্সকে যোগ করে একটি ফলাফল তৈরি করা। তাই আধুনিক শিক্ষাবিদরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে শিক্ষাকে একটি সামগ্রিক রূপ দিতে হবে। তাদের মতে, আদর্শ টিচিং বা শিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনকে যেকোন ক্ষেত্রে সামগ্রিক অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করতে হবে।সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এ যেন জিগ শ পাজলের মতো। টুকরো টুকরো পাজলকে জোড়া দিয়ে বড় একটি চিত্র তৈরি করাই যার কাজ।
কিন্তু বিষয়টা আসলে বেশ জটিল। এই ধরনের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের বেশ কিছু অসুবিধা আছে। মানুষের মন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পার্সপেক্টিভ থেকে বিকশিত হয় এবং একটা সময় পর্যন্ত তা যথেষ্ট অপরিপক্ক থাকে। মানসিকতা প্রস্তুতি ও ম্যাচুরিটি না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা এই সামগ্রিক জ্ঞানকে গ্রহণ করতে পারে না।
সত্যি বলতে, কোন বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করার আগে সেই বিষয়ে জ্ঞানের উপাদানগুলোকে লজিক দিয়ে বিচার করতে হয়।কিন্তু যে বয়সে শিশুরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে সে সময় শিশুর মধ্যে যুক্তিবোধ ততটা বিকশিত হয় না।এ ধরণের অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও, যেহেতু যুক্তি দিয়ে শিশুকে কোন কিছু শেখানো সাইকোলজিক্যালি এ্যাপ্রুভড তাই বহু শিক্ষাবিদই টিচিং মেথড তৈরি করার সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেন।
আমরা সবাই জানি, প্রত্যেকটি দেশে ন্যাশনাল কারিকুলাম থাকে।স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরা এই কারিকুলামের উপর ভিত্তি করে বানানো একটি সিলেবাসকে অনুসরণ করেই পাঠদান করেন। ফলে প্রতিটি ক্লাসেই তাদের কিছু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে হয়। এই উপস্থাপনার বাহ্যিক প্রকাশই টিচিং মেথড। পড়ানোর ক্ষেত্রে যে কোন বিষয়কে ছোট ছোট পার্টে ভাগ করে, সেগুলোকে যুক্তি দিয়ে জোড়া লাগিয়ে, সামগ্রিক ধারণাকে শিক্ষার্থীদের সামনের উপস্থাপন করার এই রীতিকে বলা হয় টিচিং মেথডের যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বা লজিক্যাল এ্যাপ্রোচ (Logical Approach)
বেশ! সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়! আদিকালে এডুকেশন সিস্টেম ছিলো শিক্ষক নির্ভর। অর্থাৎ শিক্ষক যা চাইবেন যেভাবে চাইবেন শিক্ষার্থী তা-ই শিখতে বাধ্য। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদেরা বলছেন, শিক্ষা হবে শিশুকেন্দ্রিক। অর্থাৎ এডুকেশন সিস্টেম শিশুর মনোজগত, শিশুর চাহিদা, এমনকি ক্লাসরুমেও শিশুর এ্যাক্টিভ পার্টিসিপেশনের প্রতিই সবার আগে গুরুত্ব দিবে। এই যুক্তি অনুযায়ী অনেকেই লজিক্যাল এ্যাপ্রোচকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বহু আধুনিক শিক্ষাবিদ সাইকোলজির অন্যান্য নীতিগুলো গ্রহণ করে, যুক্তিনির্ভর টিচিং মেথড থেকে সরে এসেছেন।তাদের মতে, যেহেতু আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা child centered, তাই টিচিং মেথডও শিক্ষার্থীর স্বার্থেই রচনা করা উচিত। তা করার জন্য যদি আদর্শ অবস্থা থেকেও বিচ্যুত হতে হয়, তাতেও শিক্ষার মূল আদর্শ কলুষিত হয় না।টিচিং মেথড রচনার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বা সাইকোলজিক্যাল এপ্রোচ (Psychological Approach)
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় টিচিং মেথড তৈরির ক্ষেত্রে এই দুই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেথডগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই দু’টি দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে যে-কোন আধুনিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা যায়। আমরা পরবর্তী এই দুইটি এ্যাপ্রোচকে আরও একটু ভালভাবে জানবো। সেই সাথে আমরা কোন এ্যাপ্রোচে শিক্ষার্থীদের পড়াই, কোন এ্যাপ্রোচটি গ্রহণ করা উচিত সেই বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
3,145 total views, 1 views today