রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হুট করে দেখলেন ১৩ কিংবা ১৪ বছরের স্কুল পড়ুয়া একটা ছেলে ধুমপান করছে। আপনি কী ভাববেন? কিশোররা এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! বেয়াদব ছেলে পেলে চারদিকে! এদের বাবা-মারা বা কেমন! এবার ধরুন, ১৩ কিংবা ১৪ বছরের ছেলেটি খোদ আপনারই সন্তান! কেমন লাগবে? মেজাজ অত্যধিক খারাপ হলে সেখানেই কষে কানের নিচে একটা থাপ্পড় দিয়ে বাসায় নিয়ে আনবেন, এরপর বকাঝকা কিংবা মারধর। কিংবা রাস্তায় কিছু না বললেও, পরে বাসায় আসলেই ধমক, শাসন ইত্যাদি করবেন। এরপর কী হবে? আপনার সন্তান সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবে? উহু, সে আপনি যেই রাস্তায় চলাফেরা করেন সেই রাস্তায় সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবে! এভাবে শাসন করে, বকে কিংবা ধমক দিয়ে কখনোই কোন কিছুর সমাধান সম্ভব নয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিশোরদের মাঝে ধমক ও মারধোর জেদ গড়ে দেয়। ফলে সমাধান না হয়ে বরং খারাপের দিকেই ধাবিত হয় বেশি।
বরং একটা কাজ করতে পারেন। ছোট কোন ছেলে ধুমপান করছে দেখলেই তৎক্ষণাৎ তাকেই সব দোষ না দিয়ে কিছুটা দোষ নিজেদের কাঁধেও আনতে পারেন। নিজেকে নিজেই কিছু প্রশ্ন করতে পারেন। ছেলেটা কেন সিগারেট খাচ্ছে? কোথা থেকে সিগারেট খাওয়া শিখেছে? কী কী তাকে সিগারেট খাওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে? সিগারেটের ভয়াবহতা সম্পর্ক তার অভিভাবকরা (আপনিও হতে পারেন) কেউ কি তাকে কিছু বলেনি? তার সিগারেট আসক্তি দূর করার জন্য কী কী করা যেতে পারে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরাও। চলুন একসাথেই খোঁজা যাক।
কিশোররা কেন ধুমপানে আগ্রহী হয়?
বিডি নিউজ ২৪ এর প্রতিবেধক ওমর ফারুক রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে বসে ধুমপান করা কিছু কিশোরদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তারা কেন ধুমপান করে? এর মধ্যে বেশিরভাগই হাই স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিশোররা তাদের ধুমপানে আগ্রহী হওয়ার কারণ জানান। সেগুলোই তুলে ধরা হচ্ছে আপনার জন্য।
বড়দের দেখে আগ্রহ বাড়াঃ কিশোরদের মধ্যে বেশিরভাগই ধুমপানে আগ্রহী হয় বাড়ির বড়দের ধুমপান করা দেখে। প্রথমত, বড়দের প্রকাশ্যে ধুমপান করতে দেখে ধুমপানকে একটা স্বভাবিক প্রক্রিয়া ধরে নেয় অনেকে। ধুমপানের ক্ষতির কথা বললে একজন শিক্ষার্থী জানায়-আমার বাবা, কাকারাতো অনেক দিন ধরেই ধুমপান করছে। তাদেরতো তেমন কোন ক্ষতি হচ্ছে না। তাছাড়া ধুমপান খারাপ কিছু হলেতো তারা ধুমপান করতো না। তারা করলে আমরাও পারি। এতে খারাপ কিছু দেখছি না।
ধুমপানকে ফ্যাশন ভাবে অনেকেঃ অনেকের কাছে ধুমপান আভিজাত্য বা ফ্যাশনের বাহক। তাদের ধারণা, এই আধুনিক যুগে ধুমপান না করলে স্মার্ট হওয়া যায় না। ৭ম শ্রেণীর এক কিশোর জানায়, ধুমপানে তেমন খারাপ কিছু নাই। দেখেন না, সিনেমার নায়কেরা কী সুন্দর করে সিগারেট টানে। সিগারেট খাওয়াটা আমাদের কাছে ফ্যাশন। কিংবা হিরোইজমের পরিচায়ক।
এক টানে দু টানে কিছু হয় নাঃ ছোট খোকা বড় হও, বড় হবি না? এক টানে দু টানে কিছু হয় না! এই সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনের কথা মনে আছে? হ্যাঁ, অনেকে ধুমপায়ী বন্ধুর পাল্লায় পরে ধুমপান করে। শুরুতে অস্বস্তি থাকলেও কৌতূহল বসত এক-দু টান দিতে দিতেই জড়িয়ে পড়ে আসক্তিতে। আর কম বয়সে তেজ থাকে একটু বেশি। বন্ধুদের মাঝে নতুন ও সাহসী কিছু করে না দেখাতে পারলে নিজেকে ছোট ও বোকা ভাবে অনেকে। আর সাহসী কিছু করার সবচেয়ে সহজ ও হাতের কাছের মাধ্যম সিগারেট ছাড়া কী আছে?
অতিরিক্ত মানসিক চাপঃ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল, কোচিং আর প্রাইভেট টিউশন। স্কুলের পরীক্ষা। আর পরীক্ষাসহ সব কাজে সেরা হওয়ার একটা মানসিক চাপতো বেশিরভাগ অভিভাবক সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়। একটু খেয়াল করলে আপনি নিজেই লক্ষ্য করবেন, সন্তানের সাথে সারাদিনে পড়ালেখার বাইরে আপনার আর তেমন কোন কথাই হয় না। এত এত প্রত্যাশা পূরণের ধাক্কা ও নিজের কথাগুলো বলতে না পারা থেকে অনেকেই একটু রিলিপের আশায় ধুমপানে ঝুঁকে পড়ে। আর ধুমপান করলে কিছুটা চাপ কমানো যায়, এই মিথতো বছরের পর বছর ধরে আমাদের সমাজে প্রচলিত আছেই।
কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান ধুমপানে আসক্ত কি না?
বাবা-মা মাত্রই সন্তানের আচার আচরণ খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন তার ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু চলছে। ধুমপান শুরু করার সময়ে সন্তানের আচরণে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিবে। আপনি একটু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেই তা বুঝতে পারবেন।
- পোশাক আশাকে সিগারেটের গন্ধ পাবেন
- কখনো কখনো স্কুলের ব্যাগে কিংবা প্যান্টের পকেটে দিয়াশলাইও পাবেন
- হুট করে যদি দেখেন সন্তান চকলেট, চুইংগাম ইত্যাদি খাওয়া শুরু করেছে নিয়মিত
- দাঁত হলুদ হয়ে যাওয়া
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
- নিয়মিত কাশি থাকা
- এই সময়ে সে হালকা শ্বাস কষ্টে ভুগবে
- কোন শারীরিক শ্রমের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি হয়রাণ হয়ে যাওয়া
- সে পকেট মানি কেমন নিচ্ছে তাও খেয়াল করুন। তুলনামূলক বেশি হলে কারণ জানতে চান।
- অনেক সময় টিনেজাররা রুমের দরজা বন্ধ করে সিগারেট খায়। রুমে সিগারেট গন্ধ আছে কিনা লক্ষ্য করুন। অনেকে রুমে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি স্প্রে ব্যবহার করে থাকে। যেন সিগারেটের গন্ধ বোঝা না যায়।
সন্তানকে ধুমপান থেকে মুক্ত রাখতে বাবা মার করণীয়
সন্তানের সাথে ধুমপান নিয়ে খোলামেলা কথা বলুন
আমাদের অনেকের ধারণা ধুমপান, যৌন শিক্ষার মতো বিষয় নিয়ে সন্তানের সাথে কথা বললে তারা এইসব সম্পর্কে জানবে ও আরো বেশ আগ্রহী হবে। এই ধারণাটি মোটেও ঠিক না। আধুনিকতার এই যুগে খুব সহজেই এইসব সম্পর্কে শিশু কিশোররা জানতে পারবে আপনি না জানালেও। তারচেয়ে বরং এই বিষয়গুলো সন্তান আপনার থেকেই জানুক! হ্যাঁ, আপনার সন্তানের সাথে ধুমপান নিয়ে খোলামেলা কথা বলুন। কিন্তু কখন বলবেন? সন্তান ধুমপান করুক বা না করুক ১০ বছর বয়সের মধ্যে তার সাথে ধুমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে অবশ্যই কথা বলবেন। ধুমপান কেন ক্ষতিকর, ধুমপান কেন করা যাবে না ইত্যাদি সব খুঁটিনাটি বিষয় আড্ডার ছলেই সন্তানকে জানাতে পারেন।
সন্তানের সামনে ধুমপান নয়
আপনি যদি ধুমপায়ী হয়ে থাকেন তাহলে সন্তানের সাথে ধুমপান নিয়ে কথা বলার আগেই এই অভ্যাস ত্যাগ করুন। আপনি নিজেই ভাবুন, ধুমপানের ক্ষতির কথা বলে যদি আপনি নিজেই ধুমপান করেন তাহলে তা আপনার সন্তানকে কতটা প্রভাবিত করবে? দেখা যাবে আপনার কথাকে সে সিরিয়াসভাবে নিবেই না। তবে সন্তান জন্মের সাথে সাথে ধুমপান ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। অনেকক্ষেত্রে বড়দের ধুমপানের অভ্যাস দেখেই শিশুরা ধুমপানের প্রতি কৌতূহলী হয়।
ধুমপানের ক্ষতির উদাহরণ দিন
ধুমপানের ক্ষতিকর প্রভাব সাথে সাথে না পড়ায় হয়তো সন্তানকে ধুমপানের ক্ষতিকর দিকের সাথে রিলেট করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে আশেপাশে কিংবা পরিচিত কেউ ধুমপান সম্পর্কিত কোন অসুখে আক্রান্ত হলে সন্তানকে তা জানান। এতে তার ধুমপানের ক্ষতিকর দিকের সাথে রিলেট করতে সুবিধা হবে। আপনার যদি ধুমপানের কোন অভিজ্ঞতা থাকে তাও সন্তানের সাথে শেয়ার করুন। ধুমপান ছাড়তে আপনার কেমন বেগ পেতে হয়েছে? ধুমপানের কারণে আপনার কী কী সমস্যা হয়েছে; এমন বিষয়গুলো নিঃসংকোচে সন্তানকে জানাতে পারেন। অনলাইনে থেকে ধুমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে লেখা আর্টিকেলগুলোও তাকে পড়তে দিতে পারেন।
তার বন্ধুদের কথা জানতে চান
নিয়মিত তাকে তার বন্ধুদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন। তার স্কুলের বন্ধুরা, মহল্লার বন্ধুরা, কাকে সে পছন্দ করে, কেন করে, তার কোন বন্ধুর কোন দিক সে পছন্দ করে না; তার সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে স্রেফ গল্প করুন। এই গল্প থেকেই আপনি তার বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে পারবেন। হুট করে একদিন জিজ্ঞেস করুন, তার কোন বন্ধু ধুমপান করে কি না? করলে সে সিগারেট খেতে নিষেধ করে কি না? মাঝে মাঝেই তাকেই জিজ্ঞেস করুন, তার কোন বন্ধুকে সিগারেট খেতে দেখলে সে কী করবে? তাকে কিছু দিক নির্দেশনাও দিতে পারেন এই বিষয়ে।
যদি সন্তান ধুমপানে আসক্ত হয়ে যায় তখন কী করবেন?
এই ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বাবা-মাই শাসনের পথে হাঁটেন। সন্তানকে মারধোর করে, ধমক দিয়ে, ধুমপানের জন্য নানাভাবে তাকে হেয় করার চেষ্টা করেন। এতে তেমন লাভের কিছু হয় না। বরং সন্তান চেষ্টা করে আপনাকে না জানিয়ে ধুমপান করতে। সহজ করে ভাবুন। মারধোর না। বরং তাকে সহযোগিতা করুন ধুমপান আসক্তি কমাতে। সন্তানের ধুমপান আসক্তি ছাড়ার কাজটিকে একটি টিমওয়ার্ক হিসেবে দেখুন। সেখানে সন্তানকেতো অবশ্যই যুক্ত করবেন। এতে ধুমপান ছাড়ায় সন্তান নিজেও দায়িত্ব অনুভব করবে। ধুমপান আসক্তি দূর করার জন্য নিচের টিপসগুলো কাজে লাগাতে পারেন।
- ঠিক কি কারণে সে ধূমপানে আসক্ত হয়েছে সেই বিশেষ কারণগুলি খুঁজে বের করুন। কারণ গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে তাকে বুঝাতে পারেন যে তার ধারণা ভুল।
- সন্তানকে খেলাধুলায় যুক্ত হতে উৎসাহিত করুন কেননা খেলাধুলা ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করে।
- ধূমপানের ক্ষতিকর দিক গুলো বারবার তার সামনে তুলে ধরুন। এধরণের বিভিন্ন অর্টিকেল তাকে পড়তে দিতে পারেন।
- একবারে ছাড়তে বলা আপনার জন্য যতটা সহজ তার জন্য বিষয়টা ততটা কঠিন। তাই একবারেই না বলে প্রতিদিন ১/২টা করে সিগরেট কমাতে বলুন। এভাবে ধীরে ধীরে সংখ্যাটা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সহযোগিতা করুন।
- ব্যাগে কিছু চুইং গাম বা চকলেট রেখে দিন। যখন তার ধুমপানের ইচ্ছা জাগবে তখন তাকে চকলেট বা চুইং গাম চাবাতে পরামর্শ দিন।
- আসক্তি যদি কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ধূমপানের জন্য প্রতিদিন কি পরিমাণ টাকা খরচ করছে, সেটা সপ্তাহে, মাসে এমন কি বছর শেষে যেয়ে কত দাড়াচ্ছে সেই হিসাবটা তাকে দিয়ে করান। এবার তাকে বুঝান সে কি হারাচ্ছে।
সবশেষে বলবো, সন্তানকে ভালোবাসুন। এবং অবশ্যই সে ভালোবাসাটা প্রকাশ করুন। জড়িয়ে ধরুন, চুমু দিন, বুঝিয়ে বলুন। ভালোবাসার চেয়ে বড় কোন শক্তি নেই মনে রাখবেন।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
2,117 total views, 1 views today