বয়ঃসন্ধিকাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় কিশোরকিশোরীরা অনেক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। অনেকেই এই সব পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। হয়তো এসময় কারো বিভিন্ন কারণে মন খারাপ হতে পারে। তবে তা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। তাহলে বুঝতে হবে যে সে হতাশায় (Depression) ভুগছে। যার ফলাফল তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিবে। এবং তার সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠার পথটা রুদ্ধ করে দিবে। সুতরাং আপনার একটু সচেতন পদক্ষেপই পারবে আপনার সন্তানের সুস্থ স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। সেক্ষেত্রে সচেতন হয়ে লক্ষ্য রাখুন আপনার সন্তান হতাশায় ভুগছে কি না!
হতাশায় (Depression) আক্রান্ত হলে আপনার সন্তানের মধ্যে যেসব আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, দেখে নিনঃ
১। আবেগীয় পরিবর্তন
দিনের অধিকাংশ সময় মন খারাপ করে থাকা। অতিরিক্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা এবং নিজেকে দোষী ভাবা। হুটহাট করে অযথা রেগে যাওয়া, অল্পতেই বিরক্ত হওয়া এবং অসামাজিক আচরণ করা প্রভৃতি।
২। শারীরিক পরিবর্তন
সারাক্ষণ ক্লান্তিবোধ করা, দুর্বল লাগা, হঠাৎ করেই ওজন হ্রাস পাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া। অসুস্থ হয়ে পড়া, যেমনঃ পেট, মাথা ও ঘাড় ব্যথা করা। ঘুমের সমস্যা হওয়া, যেমনঃ ইনসমেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া কিংবা বেশি ঘুম হওয়া। অথবা মন খারাপ করে সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকা প্রভৃতি।
৩। চিন্তার পরিবর্তন
পড়াশুনায় ঠিকমত মনোযোগ দিতে না পারা। বিভিন্ন কাজকর্মে তেমন আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়া। কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা এবং বিভিন্ন তথ্য মনে রাখতে না পারা ইত্যাদি।
আপনার সন্তানের হতাশা (Depression) দূর করতে আপনার করণীয় বিষয়সমূহঃ
১। মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান
আপনার সন্তানের যদি বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে দেরি না করে একজন অভিজ্ঞ মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন যে আপনার সন্তান হতাশায় ভুগছে কিনা। যদি আপনার সন্তান হতাশায় (Depression) ভুগে থাকে, তবে তাকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি ওর সব বিষয় আরও বেশি করে গুরত্বের সাথে খেয়াল রাখুন। এবং ডাক্তারের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।
২। আরও বেশি করে সময় দিন
আপনার সন্তান হতাশায় ভুগলে তাকে আগের থেকেও বেশি করে সময় দিন। তার সাথে মন খুলে কথা বলুন এবং তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তার সাথে কোন প্রকার গ্যাপ সৃষ্টি হলে তা দূর করতে সচেষ্ট হোন। তার দুঃসময়ে তার আস্থার জায়গা এবং সাপোর্ট হয়ে সবসময়ই তার পাশে থাকুন।
৩। দরকার পুষ্টিকর খাবার
বয়ঃসন্ধি কাল সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শারীরিক মানসিক পরিবর্তনগুলো খুব তাড়াতাড়ি হয়। এসময় হরমোনের দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বেশি মাত্রায় চাপ ও হতাশা কাজ করে। আর এই সব চাপ ও হতাশা (Depression) থেকে বাঁচতে আপনার সন্তানকে প্রোটিন যুক্ত খাবার বেশি করে খেতে দিন। প্রোটিন যুক্ত খাবার মানসিক চাপ আর হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
৪। দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম
টিনেজারদের জন্য ঘুম খুব দরকারী। তাদের অন্তত ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। যারা হতাশায় ভোগে তাদের অনেকেই বেশি ঘুমায় কিংবা কম ঘুমায়। অনেকে আবার সারাদিন বিছানায় পরে থাকে। আর যদি আপনার সন্তানের এই অভ্যাস থেকে থাকে তবে তাকে এই চক্র থেকে বের হতে সাহায্য করুন। তার ঘুমানোর জায়গা যেন অন্ধকার, আরামদায়ক, কোলাহল মুক্ত হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। ঘুমানোর সময় ল্যাপটপ, আইফোন, ট্যাব ইত্যাদি নিয়ে অলস সময় যেন না কাটায় সেদিকেও একটু লক্ষ্য রাখুন।
আপনার সন্তান যখন মোবাইল গেমসে (Mobile Games) আসক্ত! কী করবেন তখন?
৫। সন্তানের ভাল লাগাকে মূল্যায়ন করুন
আপনার সন্তানের ভাললাগা খারাপলাগাকে মূল্যায়ন করুন। জোর করে কোন কিছু তার উপর চাপিয়ে দিবেন না। তার মতামত নিয়ে তাকে সৃষ্টিশীল কাজের সাথে যুক্ত করুন। এবং তাকে বিভিন্ন কিছু শেখার সুযোগ করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে যেসব বিষয় অগ্রাধিকার পেতে পারে তা হল- ছবি আঁকা, ভায়োলিন শেখা, ক্যারাটে শেখা, বাগান করা, স্কাউটিংয়ে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি।
৬। ব্যায়াম-মেডিটেশন করতে উৎসাহিত করুন
নিয়মিত ব্যায়াম মেডিটেশন করলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে “এন্ডোরফিন” নিঃসরণ হয়। যা দুশ্চিন্তা কমাতে ও মনমেজাজ ভাল রাখতে সাহায্য করে। তাই দুশ্চিন্তা কিংবা মনের প্রফুল্লতা দু’টির জন্যই নিয়মিত ব্যায়াম করা হতে পারে চমৎকার একটি মাধ্যম। টিনেজ বয়সে নিয়মিত আধা ঘণ্টা করে ব্যায়াম করা উচিত। এই বয়সে জিমে না গিয়ে, সাধারণ ভাবে যেসব ব্যায়াম করা যায় তা হলঃ নিয়মিত জগিং করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো এবং মেডিটেশন করা ইত্যাদি।
৭। আস্থার জায়গাটুকু নিশ্চিত করুন
পৃথিবীতে পরিবারই সবচেয়ে নিরাপদ নির্ভাবনার মায়াময় আশ্রয়স্থল। তাইতো যেকোন সমস্যার কথা, কষ্টের বিষয় যা আপনার সন্তানের অস্বস্তির কারণ তা যেন সে আপনাদের সাথে মন খুলে শেয়ার করতে পারে। আপনারা তাকে সেই আস্থা আর নির্ভরতার জায়গাটুকু নিশ্চিত করুন। মা-বাবা, ভাইবোনের স্নেহমায়ায়, সাপোর্টে তার সমস্যাগুলো যেন সমাধানের পথে হাঁটে। আর এক্ষেত্রে খেয়াল রাখুন কেউ যেন তার সমস্যাগুলো নিয়ে হাসি তামাশা না করে। সে যেন কোনভাবেই নিজেকে ছোট ভেবে মনে কষ্ট না পায়।
৮। বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে দিন
এসময় অনেক ছেলেমেয়েই খুব বেশি হীনম্মন্যতায় ভোগে। সেক্ষেত্রে সেভাবে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তেমন একটা যোগাযোগও রাখে না। আর তা হলে এক্ষেত্রে আপনিই উদ্যোগী হোন। তার ভাল বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত করতে পারেন। যারা তার ভাল বন্ধু তারা তার পাশে সবসময়ই থাকবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে। তাই আপনার সন্তানকে তাদের সাথে একসাথে সময় কাটাতে দিন।
৯। বই পড়তে উৎসাহিত করুন
বই আত্মার খোরাক যোগায়। বই পড়লে মেধার বিকাশ ঘটে এবং আপন সৃজনশীলতা সমৃদ্ধ হয়। আর তাইতো আপনার সন্তানের হাতে বই তুলে দিন। তাকে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে উৎসাহিত করুন। তাকে মোটিভেশনাল বই কিনে দিতে পারেন। আর বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে, তার অবসর সময়ও ভাল কাটবে। এছাড়াও তাকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতে বলুন।
১০। তাকে নিয়ে ঘুরতে-বেড়াতে যান
ব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমিতা পূর্ণ রুটিন জীবনকে বিষিয়ে তোলে। আর তাইতো আপনার সন্তানকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে-বেড়াতে যান। তাকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে আসুন। খোলা পরিবেশে পরিভ্রমণ করলে তার মনে প্রশান্তি আসবে।
ছুটির দিনে, আনন্দের ঘ্রাণে- শিশুকে দিন নির্মল বাতাসের আলিঙ্গন
১১। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করুন
সৃষ্টিকর্তা সব সমস্যার সমাধান করে দেন। হয়তো ধৈর্য ধরে দুঃসময় কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আগামীর পথ হাঁটতে হয়। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলে মনে প্রশান্তি আসে, ধৈর্য বাড়ে এবং হতাশা (Depression) কমে। আর সেক্ষেত্রে আপনার সন্তানকে নিয়মিত প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করুন।
১২। তাকে অসহায় মানুষের জীবন কাছ থেকে দেখান
অনেক সময় অন্যের দুঃখ দেখে নিজের দুঃখ ভুলে থাকা যায়। আমাদের চারপাশে অনেক অসহায় মানুষ আছেন। আপনার সন্তানকে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দিন। তাদের সাহায্য করলে যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, তার মূল্য অসীম। আর তাদের কষ্টের কথা জানলে, তখন তার নিজের কষ্ট, হতাশা (Depression) অনেকটাই কমে যাবে।
আপনার অপরিসীম যত্ন আর মায়ার ছোঁয়ায় আপনার সন্তানের জীবন হয়ে উঠুক হতাশামুক্ত। সে সুস্থ সাবলীলভাবে একজন আদর্শ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,694 total views, 1 views today