সুইসাইড একটা মহামারী! সারাবিশ্বে প্রতি বছর আট লক্ষেরও বেশি মানুষ সুইসাইড করছে। মানে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজন মানুষ নিজের জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে। এবং এই সংখ্যাটার বেশির ভাগই টিনএজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী সুইসাইড সারাবিশ্বে টিনএজারদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ। যেই বয়সে আমাদের সন্তানদের জীবন সবচেয়ে বর্ণিল, আনন্দময় আর চিন্তামুক্ত থাকার কথা সেই বয়সে আমাদের সবার মাঝে থেকেও জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে তারা সুইসাইডের মতো মহামারীকে বেছে নিচ্ছে। কী কারণ আছে তাদের সুইসাইডের নেপথ্যে? আপনার সন্তানও আপনার অগোচরে সুইসাইডের কথা ভাবছে না তো? সন্তানের কোন আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে না তো? সুইসাইডের পথ থেকে তাদেরকে সরিয়ে আনতে আমাদের করার কী আছে? এইসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছে বিজ্ঞানবাক্স টিম। হ্যাঁ, আমাদের আজকের ব্লগটা টিনেজারদের সুইসাইডের কারণ ও প্রতিরোধ নিয়ে।
টিনেজারদের সুইসাইডের নেপথ্যের কারণ
টিনেজারদের সুইসাইডের নেপথ্যে অনেকগুলো কারণ থাকে। কিন্তু বিষণ্ণতা, হতাশা অথবা ডিপ্রেশন অন্যতম। বর্তমান সময়ে বুলিংকেও সুইসাইডের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ডিপ্রেশন বা হতাশা
বর্তমান সময়ে এই শব্দটা অনেক বেশি শোনা একটি শব্দ। কখনো কি ভেবেছেন, টিনেজারদের ডিপ্রেশন কোথা থেকে আসে? আপনার সন্তান ডিপ্রেশনে ভুগছে কি না? ডিপ্রেশন মূলত মস্তিষ্কের রাসায়নিক জনিত সমস্যা, যা আপনার সন্তানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, নেতিবাচক চিন্তা করতে প্ররোচনা দেয়। এই রাসায়নিক জটিলতা ঘটে মূলত ছোট ছোট কিছু ঘটনা থেকে। যেমন ধরুন, স্কুলে রেজাল্ট খারাপ হওয়া কিংবা তার কোন প্রশ্নবিদ্ধ আচরণে সন্তানকে অতিরিক্ত বকাঝকা করা। “তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তোমার মতো সন্তান না হলেই ভালো হতো, ওমুকের ছেলে তোমার চেয়ে অনেক ভালো” সন্তানকে প্রায় এমন কথা বলছেন? তবে জেনে রাখুন, নিজের অজান্তেই সন্তানকে ঠেলে দিচ্ছেন ডিপ্রেশনের দিকে। আশাহত হওয়া, নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবা, নিজেকে বোঁঝা ভাবা, নিজেকে বাবা-মার কোন হতাশা বা আফসোসের কারণ ভাবা এই ধরণের চিন্তাই একজন টিনেজারকে সুইসাইডের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বুলিং
অনেক সময় জেনে অথবা না জেনে অথবা নিছকই মজার ছলে কেউ কাউকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেয়পতিপন্ন করতে পারে। সোজা কথায় এটাই বুলিং। যেকেউ যেকোন জায়গায় বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। স্কুলে বন্ধুদের দ্বারা, বাসায় কাজিনদের দ্বারা, কখনো কখনো আত্মীয় স্বজন দ্বারাও অজান্তেই শিশুরা বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। টিনেজারকে কোন কারণে ব্যাঙ্গ করা, অপমান করে কথা বলা, তার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাওয়া, অদ্ভুত নামে ক্ষ্যাপানো ইত্যাদি বিষয়গুলো বুলিংয়ের আওতায় পড়ে। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুন হোসেনের আত্মহত্যায় পেছনে বুলিংয়ের কালো ছায়াকেই দায়ী করা হয়। বুলিংয়ের ফলে একজন মানুষ হীনম্মন্যতা ভুগতে শুরু করে। একটা সময় নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা বা মজা করার পাত্র ভেবে সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এছাড়াও আরো কিছু কারণ আছে যা টিনেজারদের সুইসাইডের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সুইসাইডের আরো কিছু কারণ
• যেকোন ধরণের সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার যেমন-ডিপ্রেশন, বিপোলার ডিসঅর্ডার, এনক্সাইটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
• মাদকাসক্ত হলে।
• আশাহত ও নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বা বোঝা ভাবলে।
• শারীরিক, মানসিক ও সেক্সুয়াল কোন এবিউজের শিকার হলে।
• বাবা-মায়ের সাথে মানসিক বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকলে। বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে।
• বন্ধু, আত্ময় ও অন্যান্য সামাজিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে।
• পরিবারের কিংবা খুব কাছের, ভালোবাসার কারও মৃত্যু হলে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান সুইসাইডের ঝুঁকিতে আছে কি না?
কোন বাবা-মায়ই সন্তানের ক্ষতি চান না। ইচ্ছে করে কেউ সন্তানকে কষ্টও দিতে চান না। কিন্তু মাঝে মাঝে আপনাদের অজান্তেই কিছু আচরণ সন্তানের উপর খুব খারাপ কোন প্রভাব ফেলতে পারে। একই সাথে সামাজিক, তার বিচরণের গন্ডি, স্কুল, বন্ধু, আত্মীয় ইত্যাদি থেকে এমন কোন প্রভাব তার উপর পড়তে পারে। সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নেয়া মানুষটি তার অনুভূতিটা শেয়ার করতে পারে না বা চায় না বলে আমরা হুট করে আবিষ্কার করি মানুষটা আর নাই। কিন্তু একবারও কি মনে হয় না, হুট করেই একটা মানুষ সুইসাইড করতে পারে না? আসলেই হুট করে কেউ সুইসাইড করে না। মুখে না বললেও সে কিছু সংকেত বা হিন্টস দিয়ে যায় সুইসাইডের আগে। সন্তানের আচরণ ও তার দিকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, আপনার সন্তান সুইসাইড রিস্কে আছে কি না! মনোবিজ্ঞানীরা তেমন কিছু আচরণ তালিকাও করেছে।
• একা একা থাকতে চাওয়া। পরিবার এমন কি সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটাকেও এড়িয়ে চলা।
• তারা আর বেশিদিন নাই এমন ইঙ্গিত দেয়া। যেমন-হুট করে বলা, আমি চলে গেলে ভালো থেকো, তোমাদের মুক্ত করে দিবো।
• আশাহতদের মত কথা বলা।
• মাঝে মাঝে সুইসাইড ও মৃত্যু সম্পর্কিত কথা বলা।
• ঠিকভাবে খেতে না চাওয়া। খেতে ডাকলে না এসে পরে একা একা খাওয়া।
• অকারণে ঘুমের অনিয়ম করা।
• প্রায় সব কিছুতেই অমনোযোগী হওয়া।
• স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
• কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে।
• নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করা, নিজের অনুভূতিকে লুকানোর চেষ্টা করা।
• ভবিষ্যত নিয়ে কথা বললে তা নিয়ে আগ্রহী না হওয়া। যেমন-ছোট খাটো পারিবারিক ভ্রমণের ব্যাপারে আলোচনা করলেও সেখানে আগ্রহ না দেয়া।
সোজা কথা, যে মানুষটা সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নেয় তার আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আসে। সে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে, স্বাভাবিক আচরণের চেয়ে কিছুতা ভিন্ন আচরণ করে যা তার প্রতি একটু মনোযোগী হলেই ধরতে পারবেন ও সেভাবে ব্যবস্থা নোট পারবেন।
সুইসাইড প্রতিরোধের উপায়
মানসিক সমস্যায় থাকা সন্তানের বিশেষ যত্ন নিন
যেসকল শিশুদের মেন্টাল ডিসঅর্ডার থাকে তাদের সুইসাইডের ঝুঁকি বেশি থাকে। এই ধরণের সমস্যায় ভোগা বা চিকিৎসাধীন থাকা সন্তানের জন্য বাবা-মাকে অনেক সচেতন হতে হবে। তাদেরকে নিয়মিত সময় দিতে হবে। তাদের অনুভূতির কথা জানতে চাইতে হবে। অবশ্যই সন্তানের কাছে তার সমস্যার কথা লুকানো যাবে না। বরং তাকে সাহস ও উৎসাহ দিতে হবে। সমস্যার কথা লুকিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেটা সন্তানের জন্য যন্ত্রণার হতে পারে যা পরে নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলতে পারে।
সন্তানের সাথে শক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন
সুইসাইড প্রতিরোধে যদি সবচেয়ে বেশী কার্যকরী কোন উপায় থাকে তা হলো সন্তানের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্ত করা। সন্তানের ভরসার যায়গা হওয়া। পৃথিবীর কেউ তার কথা না শুনলেও আপনি তার কথা শুনবেন, সন্তানের মাঝে এমন বিশ্বাস তৈরি করা। সন্তান যেন তার মনের সকল অনুভূতি নির্দ্বিধায় আপনার সাথে শেয়ার করে সে জায়গাটা নিশ্চিত করা। সন্তানের সাথে গল্প করুন, যেমন তাকে জিজ্ঞেস করুন, আজকে তার স্কুলের কোন মজার ঘটনা আছে কি না? রাস্তায় কোন মজার ঘটনা ঘটেছে কি না? স্কুলে তার সবচেয়ে পছন্দের শিক্ষক কে? সন্তান যদি আপনার সাথে কখনো কথা বলতে না ও চায় সেক্ষেত্রেও তাকে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করুন। সোজা কথা, তার ছোট থেকে বড় সকল সমস্যা ও সকল অনুভূতি জানতে চান। এতে দু-টো উপকার হবে। প্রথমত সন্তানের সাথে আপনার একটা শক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে, আপনি সন্তানের বন্ধুতে পরিণত হতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, সন্তানের আচরণগত কোন পরিবর্তন আসলে তা ধরতে পারবেন।
সন্তানকে যেকোন অবস্থায় সমর্থন দিন ও তার ভরসার জায়গা হোন
সুইসাইড করতে চাওয়া মানুষগুলো তার সমস্যা সমাধানে একটু সমর্থন ও ভরসার জায়গা পেলে সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারে। সন্তানের যেকোন সমস্যা মনযোগ দিয়ে শুনে তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য তাকে সমর্থন করতে হবে। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে? বকাঝকা না করে কেন খারাপ হয়েছে তা বের করুন এরপর তাকে সাথে করেই তা সমাধান করুন। বন্ধুদের সাথে সমস্যা? সেটা শুনে সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করুন না! সন্তান বড় কোন অন্যায় করে ফেলেছে? অন্যায়টা কেন করলো তা বের করুন, এটা কেন অন্যায় তা সন্তানকে বোঝান। আপনিই বলুননা, ধমক দিয়ে বা মারধোর করে কী সমাধান হয়ে যায়? হয় না! বরং ঘটতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা। ছোট বয়সেই সন্তান কোন ধরণের সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে? এটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে অনেক?
একবার ভাবুনতো, সন্তান ভুল করতে পারে না! ভুল করতে পারে বলেইতো তারা সন্তান। একটু কোমলভাবে সন্তানের মাথায় হাত দিয়ে সেইসব সমস্যা থেকে সন্তানকে হাত ধরে বের করতে হবে, হাত ছেড়ে দিয়ে নয়।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,653 total views, 2 views today