বাচ্চারা খেলাধুলা করবে এটাই স্বাভাবিক, কখনো খেলবে ঘরোয়া খেলা আবার কখনো বা খোলা মাঠে। কিন্তু আধুনিকতার এই যুগে প্রতিদিন খোলা জায়গা দখল করে গড়ে উঠছে আকাশছোঁয়া সুউচ্চ অট্টালিকা। ফলে বাধ্য হয়ে পর্যাপ্ত খেলার মাঠের অভাবে বাচ্চারা শুধুমাত্র ঘরোয়া খেলাকে বেছে নিচ্ছে। প্রযুক্তির এই যুগে ঘরোয়া খেলার মধ্যে মোবাইল, ল্যাপটপ বা ট্যাবে গেম খেলা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের বাচ্চাদের কাছে। লম্বা সময় ধরে খেলতে খেলতে এক সময় তাদের এই গেম খেলা পরিণত হচ্ছে আসক্তিতে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই আসক্তিকে ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে যা ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসাবে পরিচিত। আপনার সন্তানও গেমিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত নয় তো?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, “যদি কেউ ১২ মাসের বেশি সময় ধরে অস্বাভাবিক ভাবে গেমে আসক্ত থাকে তাহলে তা গেমিং ডিজঅর্ডারের আওতাভুক্ত হবে। তবে কারো ক্ষেত্রে ১২ মাসের আগেই যদি অস্বাভাবিকতার মাত্রা বেড়ে যায় তাহলে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে”।
প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় এসকল গেমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়, যা বাচ্চাদের মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগ রাখতে না রাখতেই বসে গেছে মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপ নিয়ে। স্ক্রিনে তাকালেই চোখে পড়বে পাবজি, কল অফ ডিউটি, ফার ক্রাই, ক্লাস অফ ক্ল্যান নামের বিভিন্ন গেম। স্কুল ড্রেস খোলার কথা ভুলে মনের অজান্তেই চলে যাচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে। এমন সব বিধ্বংসী গেমে আসক্ত বাচ্চারা কোন আপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়বে না এমনটা ঠিক বলা যায় না, সম্ভাবনা থেকেই যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, “প্রতিনিয়ত এসব ভিডিও গেম খেললে শরীরে একধরণের হরমোন নিঃসরণ হয়, এতে বাচ্চা সবকিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়”।
আরো পড়তে পারেন- সাইবার বুলিং একটা সামাজিক ব্যাধি।
গেম আসক্তি অনেক সময় বাচ্চার মেধা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাচ্চা অন্যের সাথে মিশতে চায় না, একাকীত্ব তাকে পেয়ে বসে, দেখা দিতে পারে ক্ষুধামন্দা, মাথাব্যথা। দিনের পর দিন অধিক রাত জাগার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়। গেম খেলায় আসক্ত বাচ্চারা রাতে অধিক সময় ধরে জেগে জেগে গেম খেলে, ফলে সকালে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। স্কুল বা হোমওয়ার্কের প্রতি বাড়তে থাকে অনীহা। অধিক সময় ধরে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্ক্রিন থেকে নির্গত রেডিয়েশনের মাত্রা ও সময় বেশি হলে হতে পারে জটিল কোন রোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, “বিশ্বে গেমারদের ২ থেকে ৩ শতাংশ গেমিং ডিজঅর্ডারে ভোগে”। খেয়াল করে দেখুন আপনার সন্তান আবার এই ২/৩ শতাংশের মধ্যে নয়তো?
কিভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান গেমিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত কি না?
অনেক লম্বা সময় ধরে গেম খেললে তা এই রোগের আওতায় পড়বে। আপনি আপনার সন্তানকে খেলা বন্ধ করতে বলছেন কিন্তু সে বন্ধ না করে আরো অধিক সময় ধরে খেলছে, বা রাগে চিৎকার করছে এমন আচরণ গেমিং ডিজঅর্ডারের ইঙ্গিত দেয়। স্কুল ফাঁকি বা হোমওয়ার্ক না করে গেম খেলছে? বুঝতে হবে আপনার সন্তান গেমিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।
বিশ্বের বড় বড় দেশ গুলো ইতোমধ্যে গেমিং ডিজঅর্ডারের প্রতিরোধ শুরু করে দিয়েছে। যেমন – জাপানে যদি কেউ একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে গেম খেলে তাকে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়। আবার বাচ্চারা কত সময় গেম খেলতে পারবে তার সময় বেঁধে দিয়েছে চীনের ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় আইন করা হয়েছে যেন ১৬ বছরের কম বয়সীরা মাঝরাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত গেম খেলতে না পারে।
আমাদের দেশে এমন কোন ব্যবস্থা আছে বলে জানা নেই। এ ব্যাপারে আমাদের এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। হুট করে একদিনেই আপনার সন্তানকে গেমিং আসক্তি থেকে মুক্ত করতে যাবেন না, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে তুলুন, তাকে বোঝান, ধীরে ধীরে তার গেম খেলার সময় কমিয়ে আনু্ন, যুক্ত করুন পারিবারিক বা সামাজিক কোন কাজে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে করণীয়
* মাঠে খেলতে নিয়ে যানঃ ঘরোয়া খেলা (মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপে অনলাইন বা অফলাইন গেম) থেকে ধীরে ধীরে বাচ্চাদের খোলামাঠের খেলাধুলা যেমন- ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, বা বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ খেলার দিকে নিয়ে আসা। এগুলো যেমন তাদের গেম খেলা থেকে দূরে রাখতে তেমনি আবার শরীরচর্চারও কাজ করবে।
* বেড়াতে নিয়ে যানঃ পিতামাতা হিসাবে তাদেরকে সময় দিন, বন্ধের দিনে বাইরের পরিবেশে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারেন। যেতে পারেন কোন ঐতিহাসিক স্থানে, চিড়িয়াখানায় বা কোলাহল মুক্ত সবুজ কোন পরিবেশে।
* বই পড়া ভারি মজাঃ বাচ্চাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। তাদেরকে বই মেলাতে নিয়ে যান, কিনে দিন তাদের পছন্দের বই।
* শখের কাজঃ শখের কোন কাজে তাকে অভ্যস্ত করার সময় এখনই। যেমন- বাগান করা, স্ট্যাম্প কালেক্ট করা ইত্যাদি। এমন কাজে অভ্যস্ত করতে আপনিই তাকে সহযোগিতা করুন।
* বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসাবে স্কাউট, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, গার্লস গাইড এধরণের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত করতে পারেন আপনার সন্তানকে। এখানে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে।
* সময় বেঁধে দিনঃ বাচ্চা গেম খেলছে অবসরে? তো খেলুক না, কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা যেন দীর্ঘ সময় না হয়। প্রয়োজনে তার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন।
* সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করুনঃ ছোট থাকতেই আপনার সন্তানকে আবৃতি, গান, নাচ, অভিনয়, ছবি আঁকা ইত্যাদি সৃজনশীল কাজে যুক্ত করতে পারেন। তবে সন্তানের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে ভুলবেন না। সে যদি অভিনয়ে ভাল হয় তাকে সেখানে সুযোগ দিন জোর করে গান শেখাবেন না।
* উপহার দিন বিজ্ঞানবাক্সঃ বিজ্ঞানবাক্স হলো নানা রকম ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে ভরা এক বাক্স। যাতে দেয়া ম্যানুয়াল বইয়ের সাহায্যে বাচ্চারা বিজ্ঞানের নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট হাতে কলমে শিখতে পারে, যে সব এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য বইয়ের কঠিন পড়া গুলো সহজ হয়ে যায় আর বিজ্ঞানভীতি কেটে যায়। বিজ্ঞানবাক্সের মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট আপনার সন্তানকে গেম আসক্তি থেকে দূরে রাখবে।
আপনার একটু সচেতনতাই পারে আপনার সন্তানের সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলতে।
তথ্যসূত্রঃ
WHO
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,779 total views, 2 views today