“ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আর অল্প কিছুক্ষণ বাকি। পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু যতই দৌড়ান পথই এগুচ্ছে না। অনেক কষ্টে যাও পরীক্ষার হলে পৌঁছলেন, এবার আর কোনভাবেই কলমে কালি আসছে না!” বাংলাদেশের এমন কোন মানুষ সম্ভবত পাওয়া যাবে না যে এই স্বপ্নটি দেখেনি! বাবা-মা, স্কুলের শিক্ষকদের আমাদের পড়ালেখা, পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ থেকেই আমরা বেশিরভাগ মানুষ এই স্বপ্নটা দেখতাম। আমাদের আজকের ব্লগের সাথে এই স্বপ্নটার পুরোপুরি মিল না থাকলেও অল্প একটু মিল আছে। আর তা হলো অভিভাবকত্ব বা প্রত্যাশার চাপ। সন্তানকে পড়ালেখা, আচার-আচরণসহ সবকিছুতে সেরা বানানোর জন্য কখনো কখনো আমরা এত বেশি চাপ প্রয়োগ করি যে সেটা সন্তান আর বহন করতে পারে না। তখনই ঘটে হিতে-বিপরীত। অতিরিক্ত চাপে সন্তান স্বাভাবিক আচরণ থেকে সরে যায়। বাবা-মার মন মতো চলতে গিয়ে হতাশা আর বিষণ্ণতায় পড়ে রোবটিক আচরণ শুরু করে। ঠিক এই সময়ে আসলেই আপনাকে বুঝতে হবে আপনার অভিভাবকত্ব আর প্রত্যাশার চাপে আপনার সন্তান পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অতিরিক্ত চাপের বেশ কিছু খারাপ ফলাফলও আপনার সন্তানের উপর পড়তে শুরু করবে।
চলুন আজকে জেনে নেই, কীভাবে বোঝা যাবে সন্তান অতিরিক্ত অভিভাবকত্ব ও প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে কি না। আর এই অতিরিক্ত প্রত্যাশা আর অভিভাবকত্বের চাপের ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে সন্তানের, জানবো তাও।
কীভাবে বুঝবেন, অভিভাবকত্ব আর প্রত্যাশার চাপ অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে কি না?
মিথ্যা বলা বা লুকানোর চেষ্টা করা
অতিরিক্ত প্রত্যাশা আর কড়া শাসনের ফলে সন্তান মিথ্যা বলা ও কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকাতে চেষ্টা করবে। স্কুলের মার্কশিট, বাড়িতে ছোট খাটো কোন ভুল বা বাড়ির বাইরে কোন ছোট খাটো অন্যায় লুকাতে শুরু করবে। স্কুলের মার্কশিট শুরুতেই আপনাকে দেখাবে না। কয়েকবার বলার পর হয়তো দেখাবে। এতে সন্তানের দোষ আপনি দিতে পারবেন না। মূলত আপনার কড়া শাসন ও বকাঝকা থেকে বাচাঁর জন্যই সে মিথ্যার আশ্রয় নিবে।
শুরুতে যে দুঃস্বপ্নের কথা বললাম অনেকেই তা সহ আরো বেশ কিছু দুঃস্বপ্ন দেখবেই। একই সাথে ঘুমেও সমস্যা হবে। মাঝরাতে হুট করে জেগে যাবে। মূলত সারাক্ষণ তার মাথার মধ্যে আপনার কড়া শাসন বা স্কুলের পড়ালেখা না পারার বিষয়টি ঘুরবে। যার ফলাফল পড়বে তার ঘুম ও অন্যান্য কাজেকর্মেও।
যে কোন কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে
আমার গল্পটি শুনুন! আগে শুধু শুক্রবার বিকেলে বিটিভিতে সিনেমা দেখাতো। স্কুল আর বাড়িতে শাসনের চাপ আমার উপর এত বেশি ছিলো যে, শুক্রবার বিকেল থেকে আমার মাঝে শনিবার প্রথম প্রহরে স্কুলে যাওয়ার ভয়টি কাজ করতো। ভালোভাবে সিনেমাও দেখতে পারতাম না। শুক্রবার বিকেল থেকেই চুপচাপ হয়ে যেতাম। এমনকি শুক্রবারে রাতের খাবারও ঠিকঠাক খেতে পারতাম না।
বেশিরভাগ শিশুর মাঝেই কিন্তু আমার মত এমন চাপ পড়ে। সন্তানের উপর অতিরিক্ত চাপ থেকে আপনার সন্তানও সবকিছুর উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। খেলাধুলা, পারিবারিক আড্ডা, এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি সব কিছুতে অনাগ্রহ তৈরি হবে। একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলেই সন্তানের মাঝে এইসব হতাশা, বিষণ্ণতা আপনি টের পাবেন।
যেকোন কিছু ভুলে যাওয়া
হোমওয়ার্ক ভুলে যাওয়া, যেকোন তথ্য অনেকবার বলার পরও মনে রাখতে না পারা, টিফিন নিতে ভুলে যাওয়া; এমন অনেক কিছুতে আপনি সন্তানের মাঝে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আবিষ্কার করবেন। হুট করে যদি একদিন চোখে পড়ে আপনার সন্তান ইদানিং সবকিছুই ভুলে যাচ্ছে, তাহলে আপনার নিজের ভূমিকা নিয়ে একটু ভাবতে বসুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের মাঝে ভুলে যাওয়ার এই প্রবণতাটি প্রত্যাশার চাপ ও কড়া শাসন থেকেই শুরু হয়।
বারবার একই ভুল করা
অতিরিক্ত চাপ সন্তানকে প্যানিকড করে তোলে। এই প্যানিকের ফলে সে একই ভুল বারবার করতে থাকে। এটা পড়ালেখাতে হতে পারে, হতে পারে ঘরের কোন কাজে। সে আসলে আপনার বকাঝকা থেকে বাঁচার জন্য প্যানিক হয়ে অনেক বেশি চেষ্টা করে ভুল না করার। একই সাথে ভুলে গেলে আপনি তাকে যে বকাঝকা করবেন তাও তার ভেতরে একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে। ফলাফল, শত চেষ্টার পরও ভুলের পরিমাণ না কমে বরং বাড়তে থাকে।
আপনার সন্তান অনেক শান্তশিষ্ট ছিলো। হুট করে লক্ষ্য করলেন বেশ রেগে যায়। খুব অল্প কিছুতেই রাগ দেখায়। ভাবছেন, কী হলো ওর! মাঝে মাঝে কয়েকটা কড়া ধমক বা মারধোরও করলেন। কিন্তু ফলাফল আসছে না কোন। এবার তাহলে একটু আপনার দিকে তাকান। দেখুনতো, তার উপর আপনার প্রত্যাশা বা শাসনের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে কি না? সন্তান যখন তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না, মূলত তখনই সে নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। ভুগবে টেম্পার ট্যান্ট্রামের মতো সমস্যায়।
অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপের ফলে সন্তানের কী ধরণের ক্ষতি হয়?
অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ ও অতি অভিভাবকত্বের চাপের ফলে সন্তানরা বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। দীর্ঘদিন এমন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে শিশুদের এইসব সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিতেও পরিণত হতে পারে।
মানসিক ক্ষতি
বাবা-মায়ের প্রত্যাশা ও নিজের চেষ্টার সামঞ্জস্য রাখতে না পারায়; একই সাথে দিনের পর দিন চাপ না কমে বরং বাড়তে থাকলে আপনার সন্তান খুব দ্রুতই হতাশায় ভুগবে। বিষণ্ণতা, হতাশা, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলাসহ আরো বেশ কিছু জটিলতা তাকে দিনের পর দিন গ্রাস করবে। এইসব সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকারক।
নতুন কিছু করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
আপনার অতি শাসন সন্তানের সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দেয়। কড়া শাসনের ভয়ে সে রুটিনের বাইরে একদমই যেতে চাইবে না। সে সবসময় চেষ্টা করবে আপনার মনের মতো করে চলতে। মূলত তার কাছে তখন আর শেখাটা মূখ্য থাকে না। মূখ্য থাকে আপনার মন মত চলে আপনার কড়া শাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া। ফলে করা হয় না নতুন কিছুও। নতুন কিছু করতে গেলে নতুন জটিলতা সামনে আসবে আর আপনি হয়তো তাকে নতুন করে বকাঝকা করবেন!
নিজের ক্ষতি করতে চাওয়া
হ্যাঁ। শুনতে ভালো না লাগলেও কড়া শাসনের থাকা ছেলেমেয়েরা নিজেদের ক্ষতি করতে চায়। মূলত টিনএজ বয়সে কড়া শাসনের মধ্যে থাকার ফলে কেউ কেউ আত্মহত্যার কথাও ভাবে। তাছাড়া সে কোন কারণে ছোট খাটো আঘাত পেলে আপনার বকাঝকার ভয়ে আপনাকে তা জানাবে না। ফলে, ছোট কোন ইনজুরিও এভাবে লুকানোর ফলে বড় কোন শারীরিক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
এ থেকে মুক্তির উপায়?
এই সমস্যা থেকে সন্তানকে মুক্ত রাখার উপায় হলো সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। সন্তানের ভুলের জন্য সবসময় তাকে ব্যর্থ না বলে, বকাঝকা না করে; ভুল, অপারগতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা। অতি শাসন, অতি অভিভাবকত্ব সমাধানের জন্য আরো কিছু টিপস জেনে নিতে পারেন আমাদের এই ব্লগটি থেকে।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,453 total views, 1 views today