সন্তান পড়তে বসতে চাচ্ছে না, পড়ায়ও মনোযোগ নেই, অসময়ে টেলিভিশন দেখছে, ছোট ভাইকে মেরেছে, স্কুলে যেতে চাচ্ছে না, এইসব কারণে মেজাজ বিগড়ে যায় আপনার? কী করেন তখন? চড়, থাপ্পড় দেন; হাতের কাছে কিছু থাকলে তা দিয়ে শারীরিক আঘাত করেন?
দেখা যায় শারীরিক আঘাতের পরই ঠিক হয়ে গেছে সব। ভয়ে ভয়ে সন্তান আর করছে না কোন ভুল। আসলেই কি ঠিক হয়ে যায় সব? মারধোরের পরেই কি সন্তান শৃঙ্খলা শিখে যায়? নাকি ভয়ে আর আতঙ্কে সন্তানের স্বভাবিক আচরণ বাধাগ্রস্থ হয়, চুপসে যায়, গুটিয়ে যায়? মারধোর কি সন্তানের উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে নাকি সন্তানের উপর পড়ে বড় ধরণের কোন নেতিবাচক প্রভাব?
শারীরিক আঘাত কি সন্তানকে শৃঙ্খলা শেখানোর কার্যকরী উপায়?
চড়, থাপ্পড় কিংবা শারীরিক আঘাতের ভয়ে সন্তানতো পড়তে বসছে। স্কুলেও চলে যাচ্ছে। একই কাজ আবার করছে না। আপাত দৃষ্টিতে তাহলে শারীরিক আঘাত বেশ কার্যকর(?)। কিন্তু এখানে একটা জিনিস খেয়াল করুন, আপনার মারধোরের কারণে তার ভেতরে একটা ভয় ও আতঙ্ক জন্ম নিয়েছে। যার ফলে সে অগ্রহনযোগ্য কাজগুলো আর করছে না ঠিকই। কিন্তু তার ভেতরে তার আচরণগুলো কেন অগ্রহনযোগ্য এই বোধ জন্ম নিচ্ছে না। ফলে সন্তানের আচরণ পরিবর্তনে মারধোর কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবও ফেলছে না। শিশুদের মনোরোগ নিয়ে কাজ করা মল্লিকা শর্মা শৃঙ্খলা শেখাতে মারধোরকে কার্যকরী উপায় বলতে নারাজ। তার মতে, এইটা সবচেয়ে সহজ, সাময়িক ও সবচেয়ে কম কার্যকর উপায়। বরং শারীরিক আঘাত শিশুদের আচরণ ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবগুলো কতটা ভয়াবহ হয় তা নিয়ে আমরা পরের অংশে জানবো।
সন্তানকে শারীরিক আঘাত কেন করেন বাবা-মা বা শিক্ষকেরা?
মাত্র অফিস থেকে এসেই কোন বিশৃঙ্খলা দেখলেন! মেজাজ একটু বিগড়ে গেলো, সন্তানকে দিলেন একটা থাপ্পড়। একটা পড়া অনেকক্ষণ ধরে বোঝাতে বোঝাতে বিরক্ত হয়ে গেলেন, অনেকবার বলার পরও সন্তান কথা শুনতে চায় না; স্কুলে যাওয়ার সময়েই তার যত বাহানা; এমন অনেক কারণ থাকে সন্তানকে শারীরিক আঘাত করার পেছনে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হলো, বাবা-মা নিজেরাও একই রকম শাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। ফলে তাদের এই একটি মাত্র উপায়ই জানা আছে। তারা মনে করেন, তারা যেহেতু এমন শাসন সহ্য করতে পেরেছেন তাহলে তাদের সন্তানও সহ্য করতে পারবে। কিন্তু সহ্য করার দিকে না গিয়ে আপনি নিজেকে একটু প্রশ্ন করুন; মার খেতে কি আপনার ভালো লাগতো? আপনার সেই সময়কার অনুভূতিটি মনে করুনতো! খারাপ লাগতো না? নিজেকে অসহায় মনে হতো না? হ্যাঁ, একই অনুভূতি আপনার সন্তানেরও হয়। আপনার সন্তানেরও মার খেতে ভালো লাগে না।
একটা প্রশ্ন হয়তো আপনাদের মাথায় ঘুরছে। ছোটবেলায় বাবা-মার এমন শাসনের ফলে আপনার জীবনতো নষ্ট হয়ে যায়নি? অনেকে হয়তো বলবেন, বাবা-মার কড়া শাসনের কারণেই হয়তো আপনি ঠিকভাবে বড় হতে পেরেছেন, সফল হতে পেরেছেন। আসলেই আপনার জীবন নষ্ট হয়ে যায়নি। কিন্তু নষ্ট হয়ে গিয়েছে আপনার শৈশব। আপনার শৈশবের অনেকটা জুড়েই কিন্তু ভয়, আতঙ্ক, হতাশা, কষ্ট দখল নিয়ে বসে আছে। আপনার বাবা-মা যদি আপনাকে কড়া শাসনের পরিবর্তে পজেটিভ পানিশমেন্ট দিতো তাহলে আপনার শৈশব আরো সুন্দর হতো, জীবন হয়তো আরো সফল হতো।
আপনার শৈশব থেকে আপনি যে আনন্দ ও সৌন্দর্য হারিয়েছেন আপনার সন্তানও সেসব হারাক তা নিশ্চই আপনি চাইবেন না?
মারধোরের চেয়ে বুঝিয়ে বলা বেশি কার্যকরী
মারধোর একদমই সাময়িক একটা সমাধান। সন্তানের আচরণ পরিবর্তনে মারধোর কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখে না। ধরুন, সন্তান স্কুলে যেতে চায় না। একদিন মারলেন, স্কুলে গেলো। মারের ভয়ে হয়তো পরেরদিনও গেলো। কিন্তু দেখবেন তৃতীয় দিন আবার গোঁ ধরবে স্কুলে না যাওয়ার জন্য। অথচ না মেরে যদি আপনি ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করেন, সে কেন স্কুলে যেতে চায় না। তার স্কুল ভীতির পেছনে মূল কারণ কী? সে স্কুলে কোন বুলিংয়ে শিকার হচ্ছে কি না? তার সব ভয় ভীতি দূর করে তাকে কীভাবে স্কুলের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়? তাহলেও কিন্তু সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই। তার স্কুল ভীতি দূর করার চেষ্টা করুন তার সাথে কথা বলেই। স্কুলের প্রতি আগ্রহী করার চেষ্টা করুন। একবার স্কুলের প্রেমে পড়ে গেলে কিন্তু প্রতিদিন নিজে থেকেই স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে, আপনাকে কষ্ট করে অতিরিক্ত চিন্তা করা লাগবে না।
অন্যদিকে তার কোন অগ্রহণযোগ্য আচরণ চোখে পড়লে তার আচরণটা কেন অগ্রহণযোগ্য, কোন ধরণের আচরণ মানুষকে কষ্ট দেয়, মানুষকে কষ্ট দেয়া কেন ভালো কাজ না, ইত্যাদি বিষয়গুলো কিন্তু তাকে আপনি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন। তাহলে একই সাথে তার আচরণও শোধরাবে ও তার ভেতরে ভালো কাজ ও খারাপ কাজের একটা বোধও জন্মাবে। পরের বার সে নিজেই ভালো কাজ ও খারাপ কাজকে চিহ্নিত করতে পারবে ও নিজেই শুধরে যাবে।
মারধোর কিংবা ধমক নয়, সন্তান বেড়ে উঠুক স্নেহের পরশে। তার শৈশবে ভয় বা আতঙ্ক না থাকুক।
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র সায়েন্স কিট অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স আপনার সন্তানের অবসর সময় সুন্দর করবে, এবং তার মেধা বিকাশে সাহায্য করবে। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
1,949 total views, 3 views today